মানবতার গোঙানি

বইয়ের পৃষ্ঠাটা উল্টাতে গিয়েও আর উল্টাল না হাম্মাদ। পৃষ্ঠার একটা কোণা ভাঁজ করে চিহ্ন দিল তারপর বইটা বন্ধ করে ফেলল। হাত দুটো উপরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে আড়মোড়া দিতে দিতে দাঁড়িয়ে পড়ল। অনেক্ষণ তো হল। কিন্তু ট্রেনের তো কোন দেখা নেই। রাত সাড়ে দশটায় ট্রেনটা দুই নং প্লাটফরম থেকে ছেড়ে যাওয়ার কথা। অথচ এখন রাত সাড়ে বারটা, কিন্তু ট্রেনটা এখনো আসেনি। 

একটু আগে সর্বশেষ চট্টগ্রামের সাদা ট্রেনটাও ছেড়ে গেল এক নং প্লাটফরম থেকে। তাই সবগুলো প্লাটফরম এখন ট্রেন আর যাত্রী শূন্যতায় ভুগছে। পাটাতন জুড়ে নেমে এসেছে মধ্যরাতের নীরবতা। শুধু দুই নং প্লাটফরমটা জেগে আছে একটা ট্রেনের অপেক্ষায়। হাম্মাদ সেই ট্রেনেরই শোভন শ্রেণীর একজন যাত্রী।

শীতের রাত। মাঘ মাসের আজ এগার তারিখ। গতবারের চেয়ে শীতের প্রকোপ কোন অংশেই কম নয় এবার; বরং একটু বেশিই বলা যায়। শ্বেত-শুভ্র কুয়াশা ঘিরে রেখেছে চারপাশের পরিবেশ। টুপটাপ করে ঝরছে কুয়াশার বিন্দুগুলো। সাথে মৃদুভাবে বয়ে চলেছে শীতের হিমেল হাওয়া। মাঝে মাঝে বাতাসের ঝাপটা এসে শীতের নতুন মাত্রা যোগ করছে। যাত্রীগুলো সব বসে আছে গুটিসুটি মেরে। উষ্ণতার একটু ছোঁয়া পেতে সবাই গায়ে জড়িয়েছে শীতের পোষাক। হাম্মাদও কোর্টের উপর একটা মোটা শাল জড়িয়ে বসে বই পড়ছিল। কিন্তু নাহ্! আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকা যায়। পা ধরে এসেছে। তাই একটু হাঁটাহাঁটি করার জন্যই উঠে দাঁড়াল।

গায়ের শালটা ভালভাবে জড়িয়ে নিল হাম্মাদ। মৃদু পায়চারি করতে লাগল প্লাটফরমের পাটাতন জুড়ে। এই প্লাটফরমে যাত্রী গিজগিজ করছে। তাই হাঁটাহাটি করতে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে। তাই যাত্রী শূন্য এক নং প্লাটফরমের দিকে হাঁটা দিল হাম্মাদ। এখানে লোকজন নেই। তবে দূরে, প্লাটফরমের মাঝ বরাবর একটা স্তম্ভের পাশে কিছু একটা দেখা যাচ্ছে বোধহয়। ওটাকে উদ্দেশ্য করেই এগিয়ে চলল হাম্মাদ। সামনে গিয়ে দেখল একটা ছেলে শুয়ে আছে। মাথাসহ অর্ধেকটা দেহ প্লাটফরমের একটা স্তম্ভের আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে। শুধু পা দু'টো দেখা যাচ্ছে। প্রচণ্ড শীতে যবুথবু হয়ে শুয়ে আছে। গায়ে একটা ছেঁড়াফাড়া পাতলা ফিনফিনে লুঙ্গী জড়ানো। দূরে একটা লাইট জ্বলছে। তারই ক্ষীণ আলোই ছেলেটার চেহারা দেখে অনুমিত হল, কুলি-মজুর হবে। আপাতত কোন ট্রেন নেই। তাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু শীতের প্রচণ্ডতায় তার ঘুম যে আসছে না সেটা বোধহয় তার চেহারা দেখে বোঝা যায়। আবার গায়ে জড়ানোর মত উষ্ণ কোন আচ্ছাদনও নেই। তাই ঐ ছেঁড়া লুঙ্গীটাই গায়ে জড়িয়ে শুয়ে আছে।

হাম্মাদ একবার নিজের দিকে তাকাল আরেকবার ছেলেটার দিকে তাকাল। তার গায়ে আছে কোর্ট-শাল আর ঐ ছেলেটার গায়ে শুধুমাত্র একটা ছেঁড়া লুঙ্গী জড়ানো। হাম্মাদের ভিতরটা প্রচ- নাড়া দিয়ে উঠল। এই শ্রেণী বৈষম্যর বেড়া তো এই হাম্মাদরাই দাঁড় করিয়েছে। হাম্মাদ হাঁটা দিল। ফিরে এল নিজের প্লাটফরমে। ব্যগটা খুলল। ভাঁজ করা একটা কম্বল বের করল। তারপর আবার ফিরে এল সেই ছেলেটির কাছে। জড়সড় হয়ে ছেলেটি তখনও ঘুমুচ্ছে। কম্বলের ভাঁজটা খুলে আলত করে ছেলেটার গায়ে জড়িয়ে দিল। কম্বলের উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে ছেলেটা একটু নড়ে চড়ে শুল। ঘুমের ঘোরেই কম্বলটা ভালভাবে জড়িয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল ছেলেটা। 

হাম্মাদের ভিতরটা হালকা হল। অসম্ভব ওজনের একটা ভারী বোঝা যেন নেমে গেল। কিছুক্ষণ ছেলেটার ঘুমন্ত চেহারাটার দিকে তাকিয়ে থাকল হাম্মাদ। তারপর হাঁটতে লাগল। প্লাটফরমের শেষ প্রান্তটায় এসে আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে এখন অনেক তারা। কেনটা উজ্জ্বল, কোনটা অনুজ্জ্বল। তবে সবগুলো জ্বলছে মিটিমিটি। তারাভরা রাতের আকাশ দেখতে দেখতে হাম্মাদের চোখ বেয়ে নেমে এল দু’ফোটা অশ্রু জল। এ কান্নার অশ্রু নয়, আনন্দাশ্রু। শীতার্ত মানবতার একটু উপকার করতে পারার আনন্দ। এ সময় দূর থেকে ভেসে এল আগত ট্রেনের হুইসেল। হাম্মাদ সচকিত হল। চোখ দু’টো মুছে দুই নং প্লাটফরমের দিকে পা বাড়াল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন