.....ভোর তখন চারটা পঁচিশ মিনিট।
ফজরের নামাজের জন্য সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠেছি। আড়মোড়া ভাঙতে না ভাঙতেই মোবাইলে সশব্দে
একটা মেসেজ আসে। দুই লাইনের ছোট্ট একটা ট্যেক্সট মেসেজ-
"Arif, Chole jai,
abong doa chai."
মেসেজটা পড়ে ঘুমের জড়তা
যেন কোথাও উবে গেল। চেক করে দেখি নাম্বারটা এক পুরোনো সহপাঠীর। উসমান। মাদরাসাতুল মাদীনায়
যখন পড়ি তখন সেই ছিল আমাদের গ্রুপ লিডার বা ফরিক আমীর। সম্পর্কে সে আদীব হুজুরের ভাগিনা।
অল্পতেই সবার সাথে মায়ায় জড়িয়ে যেত। অন্যান্য ফরীকগুলোর তুলনায় আমাদের ফরীকে সবার মাঝে
মিল-মুহাব্বতটা বোধহয় একটু বেশিই ছিল। আর এর পেছনে সবটুকু অবদান ছিল উসমানের। মাঝে
মাঝে বেশ খুনসুটি আর মন কালাকালিও হত। সেক্ষেত্রে সেই খুব সতর্কতার সাথে পরিস্থিতি
স্বাভাবিক করত। অথচ সেও ছিল আমাদের একেবারেই সমবয়সী।
তৃতীয় বর্ষের প্রথমার্ধ
তখন শেষ। পরীক্ষার ফলাফল এবং ছুটির ঘোষণার অপেক্ষায় ছিলাম। এসময় ছুটির ঘোষণার পরিবর্তে
আসল উসমানের বিদায়ের ঘোষণা। দেশ ছেড়ে পাড়ি জমাবে বিদেশ। সেই সুদূর এমেরিকা। ওর বাবা-মা
ছিলেন এমেরিকা প্রবাসী। তাই ওরও ডাক এসেছে প্রবাস জীবনের। সেও চলে গেল। আমার পষ্ট মনে
আছে, সেদিন আমাদের ফরীকের সবাই কেঁদেছিল। কেমন যেন অভিবাবকশূন্য
লাগছিল।
বছর তিনেক উসমান এমেরিকায়
ছিল। দারুল উলূম নিউয়ার্ক এবং কানাডার সীমান্তে
এক জামিয়াতে পড়ালেখা করত। প্রায়শই ফোনে কথা হত।
উচ্চতর পড়াশোনার তেমন ভাল ব্যবস্থা না থাকায় সে আবার দেশে ফিরে আসে। ততদিনে
আমরা সবাই বিচ্ছিন্ন। কারো সাথে তেমন যোগাযোগ নেই। শুধু শুনেছি উসমান দেশে আছে। কিন্তু
দেখা করার সুযোগ কখনো হয়ে উঠে নি। মাস দুয়েক আগে হঠাৎ একদিন কাকতালীয়ভাবেই ওর সাথে
দেখা হয়। এরপর আবার পুরোনো স্মৃতির পথ ধরে ফোনালাপ, কথাবার্তা, ঘনিষ্ঠতা। শুনলাম, মারকাযুদ্দাওয়ায় পড়ছে। এই বছরই বাংলাদেশে তার পড়ালেখার পাঠ
শেষ। তাই বাংলাদেশের 'রিযিক'ও শেষ করে ফেলেছে। বছর শেষে পাড়ি জমাবে এমেরিকা।
কিন্তু সেই বছরটা যে এত
তাড়াতাড়ি শেষ হবে সেটা আগে ভাবি নি। আজ ভোর পাঁচটায় সে উড়াল দিয়েছে। আবার কবে ফিরবে
আল্লাহ মা'লুম। ওদের তো উড়াল দেয়ার
অভ্যেস আছে। তাই স্থান-কাল-মানুষের প্রতি এতটা প্রীতি অনুভব করে না। পিছু টান সহজে
ঝেড়ে ফেলতে পারে। পাখি যেমন এডাল থেকে ওডালে ওড়ে, এগাছ থেকে ওগাছে পাড়ি জমায়, অথচ কোন পিছুটান
নেই। কিন্তু আমাদের যাদের উড়াল দেয়ার অভ্যেস
নেই তারা তো ভুলতে পারি না জীবন-মানুষে জড়িয়ে থাকা এসব স্মৃতি। তাই দূর আকাশে ওদের
ওড়াল স্মৃতির পানে তাকিয়ে থাকি আর দীর্ঘ নি:শ্বাস ছাড়ি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন