হিজাব ও পর্দা : পার্থক্য নিরূপণ

দৃশ্যপট (এক)

সেদিন অনলাইনে একটা ভিডিও দেখলাম। মধ্যপ্রাচ্যের কোন এক দেশের হবে বোধহয়। রাতের ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলোয় দেখা যাচ্ছে, আজানু লম্বিত বোরকা পড়ে, নেকাবে মুখ ডেকে দুটো মেয়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। পেছন থেকে দুটো ছেলে মেয়ে দুটোর ইজ্জত হানি করার চেষ্টা করছে। তৃতীয় আরেকটি ছেলে এই দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করছে। মেয়ে দুটো বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে, ছেলেদুটোর বখাটেপনা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য দৌড়ে পালাতে চাচ্ছে। কিন্তু ছেলে দুটোর সাথে পেরে উঠছে না। এই ভিডিও যে শেয়ার করেছে সে ক্যাপশনে লিখেছে, “বোরকা বা পর্দা ইভটিজিং বা ধর্ষণ রোধে কোন কার্যকর প্রথা নয়, বরং একটি অবোরধ প্রথা তা এই ভিডিওটা দেখলেই পরিস্কার হয়ে যাবে”।

দৃশ্যপট (দুই)

কিছু দিন আগের কথা। ১লা বৈশাখের বর্ষ বরণ অনুষ্ঠানে টি এস সি চত্বরে যে পাশবিক নারি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল তার কিছু দিন পর। আমার পরিচিত একজন ফেইসবুকে টি. এস. সি. চত্বরের ঘটনা নিয়ে পোস্ট দিল। সেখানে সে আক্রান্ত নারিদের গালিগালাজ করে লিখল, “ঠিকই আছে! উচিৎ বিচার হয়েছে!! পর্দা ছাড়া কেন রাস্তায় বের হও তার মজা বোঝ। আল্লাহ বলেছেন পর্দা করে বের হতে আর তোমরা বের হও বেহায়ার মত উলঙ্গ হয়ে। এবার বোঝ মজা!! যেই ভাইয়েরা এদের ইযযত হানি করেছে তাদেরকে সাধুবাদ জানাই। যখনই তোরা বেপর্দা হয়ে রাস্তায় বের হবি তখনই যেন তোরা এমন পরিস্থিতির স্বীকার হ এই দোয়া করি!!!!!”

প্রথম ঘটনার ক্যাপশনের যিনি জন্মদাতা তিনি বোঝেন নি, পর্দা ও হিজাব কাকে বলে। দ্বিতীয় ঘটনার স্ট্যাটাসের যিনি জন্মদাতা তিনিও পর্দার হাকিকত বোঝেন নি। ইসলামে পর্দার বিধান যে শুধু নারীদের জন্য নয়, বরং প্রত্যেকটা পুরুষের উপরও পর্দা করা ফরজ- এই উপলব্ধিটুকুও আমাদের মনন-মানষিকতা থেকে ঝেঁটে বিদায় নিয়েছে। আস্তিক হোক, নাস্তিক হোক সবাই মনে করি, পর্দা শুধু নারীদের জন্য; পুরুষরা এর আওতার বাইরে। তাই নাস্তিকদের দাবী হল, ইসলাম নারিদের উপর অবিচার করেছে, অবরোধ প্রথা আরোপ করেছে। আর আস্তিক ভাইদের বক্তব্য হল, নারিরা পর্দা করে না বিধায় আজ সমাজের এই বেহাল দশা। আর আমরা পুরুষরা সাধু, সুপুরুষ, পুত-পবিত্র মহাত্মা। কিন্তু ইসলাম পর্দা সম্পর্কে কী বলে? কোরআন ও হাদীসের আলোকে পর্দার মূল আবেদনটা কী? সে বিষয়ে আমরা অনেকেই অজ্ঞ, ওয়াকিফহাল নই। আসুন, দেখি কোরআন ও হাদিস কী বলে?


পর্দা কাকে বলে?

প্রথমেই জেনে রাখা উচিৎ- পর্দা কোন প্রথা নয়, পর্দা মানে শুধু বোরকা নয়, পর্দা মানে শুধু হিজাব বা নেকাবও নয়, পর্দা মানে শুধু দূরত্ব বজায় রাখাও নয়, বরং পর্দা হল এক মানবিক শালীনতার নাম, পর্দা হল- নারী পুরুষের এতুটুকু মানষিক ও শারিরিক দূরত্ব বজায় রাখা, যার দ্বারা একজনের উপর আরেক জনের যৌন কোন প্রভাব সৃষ্টি হতে না পারে। হতে পারে সেটা মানষিক দুর্বলতা, আবেগ, ভালবাসা, প্রেম-প্রীতি, শারিরিক সম্পর্কসহ সবই। এই সকল কু প্রভাব থেকে নারী ও পুরুষ উভয়েই দূরত্ব বজায় রেখে চলার নামই হল পর্দা।

এখন এই দূরত্ব কিভাবে বজায় রাখবে তার পদ্ধতি ইসলামে বলে দিয়েছে। সেটা কখনো বোরকা-নেকাবের মাধ্যমে হয়, কখনো দৃষ্টি নতজানু রাখার মাধ্যমে হয়, কখনো বা দূরত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে হয়।
অতএব- কেউ বোরকা-নেকাব করে বাইরে বেরুল ঠিকই কিন্তু কলেজ শেষে বয় ফ্রেন্ডের সাথে আড্ডায় মশগুল হল তাহলে এটাকে বোরকা বলা গেলেও পর্দা বলা যাবে না।
পর্দানশীন প্র্যাক্টিসিং মুসলিম ছেলে ও মেয়ে। কেউ কাউকে দেখে না। তাদের মাঝে শত মাইলের দূরত্ব। কিন্তু অনলাইনের চ্যাটিং বক্সে চলছে তাদের জম্পেশ আড্ডা। এই দূরত্ব ও না দেখাকে আর যাই বলি পর্দা বলা যাবে না।
গায়রে মাহরাম আত্মীয়-চাচাত ভাই-বোন, মামাত ভাই-বোন, খালাত ভাই-বোন, ফুফাত ভাই-বেন অথবা তালত ভাই-বোন কিংবা ভাবী-দেবর; কেউ কাউকে দেখা দেয় না, শতভাগ দূরত্ব বজায় রেখে চলে কিন্তু সুযোগ পেলেই পর্দার আড়ালে থেকে, দেয়ালের ওপাশ থেকে অপ্রয়োজনীয় গল্প চলে, চলে হাস্যরস কথাবার্তা। এখানে পর্দা বা দেয়ালের আড়াল থাকতে পারে কিন্তু পর্দা রক্ষা হয়নি।
কেউ কাউকে দেখছে না কিন্তু ফোনে বা মেসেজে চলছে পরস্পর বাক্যালাপ, ফোনালাপ। এখানে না দেখলেও পর্দা হয়নি। সুতরাং পর্দা কোন সীমাবদ্ধ ফর্মলিটির নাম নয়, পর্দা হল এক ব্যপক কনসেপ্টের নাম, এক ব্যপক মানবিক মূল্যবোধের নাম, যা মানব জাতির অগণিত বিপর্যয়ের সুরক্ষা চাবি।

কখন কিভাবে পর্দা করতে হবে, পুরুষের পর্দার বিধান ও পদ্ধতি কী, নারীর পর্দার বিধান ও পদ্ধতি কী সেটাই আমরা কোরআন ও হাদীসের আলোকে দেখবো ইনশাআল্লাহ।  

পর্দার প্রথম স্টেপ : দৃষ্টি সংযত রাখা

নারী-পুরষ একে অপরের প্রতি যৌন আকর্ষণ সৃষ্টির প্রধান ও প্রথম হাতিয়ার হল- দৃষ্টি বা নযর। দৃষ্টিই প্রথম একজনের চোখে আরেকজনকে রঙ্গীন ও স্বপ্নময় করে তোলে। এইজন্য দৃষ্টিকে সংযত রাখা বা নযরের হেফাজত করাই হল পর্দার প্রথম ও প্রধান স্তর। এক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়েই সমান। চলতে ফিরতে একজন পুরুষ যেমন তার দৃষ্টিকে হারাম ব্যক্তি ও বস্তু থেকে সংযত রাখবে, ঠিক একজন নারীও চলতে ফিরতে তার দৃষ্টিকে হারাম ব্যক্তি ও বস্তু থেকে সংযত রাখবে। দেখি কোরআন ও হাদিসে পর্দার এই গুরুত্বপূর্ণ স্টেপ সম্পর্কে কী আলোকপাত করেছে।

কোরআনের সূরা নূরের ৩০ ও ৩১ নং আয়াত। ৩০ নং আয়াতে আল্লাহ তা’লা পুরুষদেরকে সম্বোধন করেন আর ৩১ নং আয়াতে নারীদের সম্বোধন করেন।
৩০ নং আয়াতে আল্লাহ তা’লা পুরুষদেরকে বলেন-
قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ (سورة النور-৩০)
অনুবাদ- হে নবী, আপনি মুমিন পুরুষদেরকে বলে দিন, তারা যে নিজেদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানকে হেফাজত করে। এটা তাদের জন্য অধিক পবিত্রতার মাধ্যম। নিশ্চয় আল্লাহ তা’লা তাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে সম্যক অবগত। (সূরা নূর-৩০)

৩১ নং আয়াতে আল্লাহ তা’লা নারীদেরকে বলেন-
وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ (سورة النور-৩১)
অনুবাদ- হে নবী, আপনি মুমিন নারীদেরকে বলে দিন, তারা যে নিজেদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানকে হেফাজত করে। (সূরা নূর-৩১)

আয়াত দুটোতে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল- সম্বোধন ও শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা’লা নারী-পুরুষের মাঝে কোন পার্থক্য করেন নি এবং প্রত্যেককে আলাদা আলাদা নির্দেশ দিয়েছেন, তবে একই শব্দে একই বাক্যশৈলীতে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নারী-পুরুষ উভয়কেই দৃষ্টি সংযত রাখা এবং নিজ লজ্জাস্থানকে অপাত্রে না ব্যবহার  করার ব্যপারে সমান গুরুত্ব দিতে হবে।

(চলমান....)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন