কওমী সিলেবাস : একটি পর্যালোচনা

গতকাল সকালে বেরিয়েছিলাম আইম্মায়ে মাসাজিদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে। আমাদের বিভাগের নতুন শিক্ষা কারিকুলামের ব্যপারে তাদেরকে অবহিত করা এবং এব্যপারে তাদের সুপরামর্শ চাওয়াটাই ছিল সফরের মুখ্য উদ্দেশ্য। প্রায় ত্রিশটা মসজিদের ইমামদের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ! সবাই এই নতুন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন অন্তত একথা বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘যুগের প্রয়োজনে এই কারিকুলাম এবং এই পদ্ধতি কার্যকর বলেই মনে হচ্ছে। তবে সঠিক দিক নির্দেশনা পেলে এবং সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করলে আশা করা যায় কওমী শিক্ষা পদ্ধতিতে এটি একটি মাইল ফলক হিসেবে কাজ করবে

তবে আশ্চর্যের বিষয় হল,  সচেতনতার এই যুগে এসেও এমন এক আলেমের দেখা পেলাম যিনি কওমী সিলেবাসে বাংলা-ইংরেজীর অন্তর্ভূক্তি এবং উর্দু-ফার্সির বিলুপ্তির কারণে সিলেবাসের ভবিষ্যত নিয়ে বেশ হতাশ। তাঁর ভাষ্যমতে, “যেদিন কওমী সিলেবাসে বাংলা-ইংরেজীর অনুপ্রবেশ ঘটেছে সেদিন থেকে ইলম উঠে গেছে আসমানে।” তাঁর মতে, দরসে নেযামীর মৌলিক কিতাবাদি হল, তাইসীর, মিযান, নাহবেমীর, গুলিস্তা, বুঁস্তা, ইলমুস সিগা, মালাবুদ্দা মিনহু, পাঞ্জেগঞ্জ ইত্যাদি আর এসব কিতাবাদি ফার্সিতে লেখা। এগুলো না পড়ে কেউ আলেম হতে পারে না!! অথচ প্রত্যেকটা মাদরাসা থেকে এগুলো উঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফার্সি উঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। তাই ইলম উঠে যাচ্ছে। শেষতক এও বলেন, “পাকিস্তান পিরিয়ডে আমরা যখন পড়ালেখা করেছি তখন মাদরাসাগুলোতে পড়ালেখা ছিল কিন্তু  এখন মাদরাসাগুলোতে কোন পড়লেখা নেই। কোথাও পড়ালেখা নেই। আগে হাটহাজারী-মেখলে কিছু পড়ালেখা ছিল এখন ওখানেও নেই। এমনকি দারুল উলূম দেওবন্দেও এখন পড়ালেখা নেই। ওখানেও এখন ফার্সির গুরুত্ব কমিয়ে দিচ্ছে.....................

এই লোকের সাথে কথা বলে নতুন কিছু অভিজ্ঞতা হল। সবাই যখন সিলেবাস নিয়ে ইতিবাচক কিছু ভাবছে, যুগ ও  সমাজের উপযোগী করে গড়ে তুলতে চাইছে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে সেখানে এই লোকের বৃত্তবন্দী চিন্তা-ভাবনা সত্যিই আশ্চর্যের।

ফার্সিভাষী মোগলরা উপমহাদেশ ছেড়েছে প্রায় তিনশত বছর আগে। পরশুই তো গেল সেই পলাশী দিবস। ২৩ শে জুন। ১৭৫৭ এর এই দিনেই তো ইংরেজদের হাতে মোগলদের পরাজয়ের সূচনা হয়। এর আগ পর্যন্ত গোটা ভারতবর্ষেই ছিল ফার্সিভাষী মোগলদের স্বর্ণযুগ। অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে নিয়ে রাজকার্যের সর্বত্রই ছিল ফার্সীভাষার আধিপত্য। তিনশত বছর আগেরে সেই সময়টাতে শিক্ষাব্যবস্থা ফার্সি ভাষার উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়াটাই ছিল সময়ের দাবী। কিন্তু তিনশত বছর পর যখন উপমহাদেশে ফার্সি ভাষা লুপ্তপ্রায় তখন পুনরায় সেই ভাষাটাকে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করাটা কতটুকু যুগ সচেতনতার পরিচায়ক!! এ তো আধুনিক যুগে বিস্মৃত গ্রীকভাষায় বিজ্ঞান চর্চার নামান্তর। ফার্সিভাষা, উর্দুভাষা এগুলো শিক্ষাব্যবস্থায় তৃতীয় ভাষা হিসেবে পাঠদান করার দাবী রাখে। কিন্তু পুরো শিক্ষাব্যবস্থাটাই তৃতীয় কোন ভাষার উপর নির্ভরশীল করে ফেললে মৌলিক বিষয় কতটুকু অর্জিত হবে তা তো সুস্পষ্ট।

এটা তো দিবালোকের ন্যয় সুস্পষ্ট, দরসে নেযামীর মৌলিক বিষয় হল কুরআন এবং হাদীস। এবং মৌলিক কিতাবাদি সব হল আরবীতে। মাদানী নেসাবে পড়ি আর কাদীম নেসাবে পড়ি, যেই নেসাবেই পড়ে আলেম হই না কেন আমাদের মাকছাদ কিন্তু কুরআন এবং হাদীস। আর কুরাআনও আরবীতে, হাদীসও আরবীতে। কুরআন হাদীস থেকে উদ্ভূত ফিকহও আরবীতে। কুরআনের তাফসীর, সেও আরবীতে। তাই সিলেবাসের মূল কিতাবাদি হবে, তাফসীরে জালালাইন, তাফসীরে বায়যাবী, সিহাহ সিত্তাহ, মেশকাতুল মাসাবীহ, হেদায়া, শরহে বেকায়া, নূরুল আনওয়ার ইত্যাদি। আর এসবগুলো কিতাবই আরবীতে রচিত। এমনকি কাফিয়ার পর থেকে উল্লেখযোগ্য উর্দু-ফার্সি কোন কিতাবই নেই। এরপরও দরসে নেযামীতে আরবীভাষার গুরুত্ব একেবারেই অপ্রতুল। উর্দুভাষা শেখানোর জন্য উর্দু জামাতে যে পরিমাণ তামরীন ও অনুশীলন হয় এবং ফার্সিভাষা শেখানোর জন্য তাইসীর জামাতে যে পরিমাণ কসরত করা হয় তার যৎসামান্য পরিমাণও করা হয় না আরবী ভাষার শেখানোর পেছনে। এমনকি মিযানুস সরফ, নাহবেমীর, ইলমুসসীগা এসকল আরবী ব্যকরণের কিতাবগুলোও পড়ানো হয় ফার্সীতে। যারফলে আরবী ভাষায় ছাত্ররা চরম দীনতার শিকার। একারণে মৌলিক কিতাবাদিতে তারা তুলনামূলোক দুর্বল থেকে যায়। অথচ এই আরবীভাষার সোপান বেয়েই তারা কুরআন ও হাদীসের ক্লাশগুলো পাড়ি দিবে। কিন্তু সিঁড়ি যদি হয় নড়বড়ে তাহলে যেই পা রাখবে সেই তো পড়ে যাবেদরসে নেযামীর এই অবহেলিত দিকটার কথা না ভেবে শুধু ফার্সী আর উর্দুর ভবিষ্যত নিয়ে ভাবলে পরবর্তী প্রজন্ম কিন্তু বেড়ে উঠবে অযোগ্যতার কলঙ্ক নিয়ে। বোঝা হয়ে দাঁড়াবে সমজা ও সমাজের মানুষের কাছে।  


(মানুষটাও ছোট, মুখটাও ছোট। ছোট মুখে বড় কথা বলে ফেললাম। আল্লাহর কাছে কৃপা কামনা করি। আশা করি আপনারাও ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন