(জুমার বয়ান)
আসসালামু আলাইকুম।
আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ তা’লার দরবারে লাখো-কোটি শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতা যে, আল্লাহ তা’লা আজকের এই পবিত্র জুমার দিনে দুনিয়াবি ব্যস্ততা থেকে মুক্ত করে আগে ভাগে মসজিদে আসার সুযোগ করে দিয়েছেন। দ্বীন ও ঈমান সম্পর্কে, কিছু কথা বলার ও শোনার সামর্থ দিয়েছেন। এই জন্য মহান আল্লাহ তা’লার দরবারে মৌখিক কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বলি- আলহামদুলিল্লাহ।
মুহতারাম মুসল্লিয়ানে কেরাম!
সহীহ বুখারী এবং সহীহ মুসলিম উভয় কিতাবেই একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। কিয়ামতের ময়দানে যখন সকল বান্দা যখন আল্লাহ তা’লার সামনে উপস্থিত হবে। তখন সূর্য থাকবে মানুষের মাথার মাত্র আধ হাত উপরে। বিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে সূর্য বর্তমানে নয় কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইল দূরে অবস্থিত। কিলোমিটারে হিসেব করলে প্রায় চৌদ্দ কোটি কিলোমিটার দূরে আছে। তারপরও গ্রীষ্মকালে যখন সূর্যের তাপ বাড়তে থাকে তখন বাসা-বাড়ি, গাড়ি-অফিস সর্বত্রই এসি লাগিয়েও মানুষ গরমে ঘামতে থাকে। কোটি কোটি মাইল দূরের সূর্যের তাপও তখন সহ্য করা যায় না। আর কেয়ামতের ময়দানে সূর্য যখন আধ হাত উপরে থাকবে তখন মানুষের কী অবস্থা হবে!? অসহ্য তাপে মানুষ তখন কতটা ছটফট করবে!?
হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে- তখন সূর্যের সেই তাপে মানুষ অঝোরে ঘামতে থাকবে। প্রত্যেকে তার গোনাহ অনুযায়ী ঘামের মাঝে ডুবতে থাকবে। কেউ হাঁটু পরিমাণ, কেউ কোমর পরিমাণ, কেউ বুক পরিমাণ, কেউ গলা পরিমাণ আর কারো গোনাহ এত পরিমাণ হবে যে সে তার ঘামের অথৈ সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকবে। সেই কঠিন মুহূর্তে সূর্যের প্রচ- তাপ থেকে বাঁচার জন্য মানুষ হাহাকার করবে। ঘামের এই নদী থেকে মুক্তির জন্য মানুষ পেরেশান হয়ে ছুটতে থাকবে। কিন্তু বিচার হওয়ার আগ পর্যন্ত মানুষ এই অবস্থা থেকে রেহাই পাবে না। সেদিন বাঁচার জন্য কোন আশ্রয় থাকবে না। সূর্যের তাপ থেকে মুক্তির জন্য কোন ছায়া থাকবে না।
তবে একটা আশ্রয় থাকবে। একটা ছায়া থাকবে। সেটা হল আল্লাহ তা’লার আরশে আযীমের ছায়া। সেই কঠিন পরিস্থিতিতে আল্লাহ তা’লা একদল লোককে তার আরশে আযীমের নীচে ছায়া দিবেন, আশ্রয় দিবেন। কারা পাবে সেদিন আরশে আযীমের ছায়া? কোন শ্রেণীর মানুষকে সেদিন আল্লাহ তা’লা কঠিন মুহূর্তেও তাঁর আরশে আযীমের নীচে আশ্রয় দিবেন? সেই লোকদের পরিচয় সম্পর্কেই সহীহ বুখারি ও সহীহ মুসলিমের এক হাদিসে আল্লাহ রাসূল সা. এরশাদ করেন-
(( سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللهُ في ظِلِّهِ يَوْمَ لا ظِلَّ إِلاَّ ظِلُّهُ : إمَامٌ عَادِلٌ ، وَشَابٌ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ اللهِ تَعَالَى ، وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ بِالمَسَاجِدِ ، وَرَجُلاَنِ تَحَابّا في الله اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وتَفَرَّقَا عَلَيْهِ ، وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ، فَقال: إنِّي أَخَافُ الله، وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأخْفَاهَا حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُه مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ ، وَرَجُلٌ ذَكَرَ الله خَالِياً ففاضت عَيْنَاهُ )) متفقٌ عَلَيْهِ
অনুবাদ- “সাত শ্রেণীর মানুষকে সেদিন আল্লাহ তা’লা তাঁর ছায়ায় আশ্রয় দিবেন, যেদিন তাঁর ছয়া ভিন্ন আর কোন ছায়া থাকবে না। এক. ন্যায় বিচারক শাসক। দুই. এমন যুবক, যে তাঁর যৌবনকাল তাঁর প্রভুর ইবাদতে ও আনুগত্যে কাটিয়েছে। তিন. ঐ ব্যক্তি, যার হৃদয় সর্বদা মসজিদে পড়ে থাকে। চার. ঐ দুই ব্যক্তি, যারা শুধু আল্লাহ তা’লার উদ্দেশ্যে পরস্পর মুহাব্বত করে, আল্লাহ তা’লার জন্যই মিলিত হয়, আবার আল্লাহ তা’লার জন্যই পৃথক হয়। পাঁচ. ঐ ব্যক্তি, যাকে সুন্দরী ও সম্ভ্রান্ত কোন মেয়ে কু-প্রস্তাব দেয়ার পরও বলে- ‘আমি তো আল্লাহ তা’লাকে ভয় করি’। ছয়. ঐ ব্যক্তি, যে আল্লাহর রাস্তায় এমন গোপনে ব্যয় করে যে, তাঁর বাম হাতও জানে না ডান হাত কী দান করল? সাত. এমন ব্যক্তি, যে নির্জনে-নিভৃতে আল্লাহ তা’লার যিকির করে, আল্লাহ তা’লাকে স্মরণ করে, আর তার দু চোখ বেয়ে অশ্রু প্রবাহিত হতে থাকে।” (সহীহ বুখারী-১/২৩৪, সহীহ মুসলিম-২/৭১৫)
উল্লেখিত সাত শ্রেণীর মানুষের মধ্য থেকে আজকের আলোচ্য বিষয় হল দ্বিতীয় শ্রেণী। অর্থাৎ- এমন যুবক, যে তাঁর যৌবনকাল আল্লাহ তা’লার ইবাদতে কাটিয়েছে। মানুষের জীবনের কয়েকটি ধাপ আছে। শৈশব, তারুণ্য, যৌবন, পৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য। এসব কালের মধ্যে সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ সময় হল যৌবনকাল। জীবনের ক্যারিয়ার গঠন করা, শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ করা, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, বিয়ে-শাদি, সংসার-ফ্যামিলি ইত্যাদি সব কিছুর মুখ্য সময় হল এই যৌবনকাল। যৌবনকালে করা প্রতিটি কাজের যেমন গুরুত্ব আছে তেমনই যৌবনকালে করা ইবাদতেরও বিশেষ গুরুত্ব আছে। বৃদ্ধবয়সের ইবাদত-বন্দেগি আর যৌবনের ইবাদত বন্দেগি আল্লাহর নিকট মর্যাদায় কখনো সমান নয়। যৌবনকালে দুনিয়া থাকে রঙ্গীন, গোনাহের প্রতি থাকে অদম্য স্পৃহা, ফূর্তি, ভোগ-উপভোগে মন পড়ে থাকে সর্বদা। তাই সেই কঠিন মুহূর্তে সকল বাঁধা-প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিতে লিপ্ত হওয়া খুব সহজ ব্যপার নয়। অন্যদিকে বুড়ো বয়সে দুনিয়া থাকে ফ্যাকাশে, গোনাহের প্রতি তেমন কোন আগ্রহ থাকে না, বলতে গেলে গোনাহ করার শক্তি-সামর্থ্যও লোপ পেয়ে যায়, দুনিয়ার প্রতি মোহ কমে আসে তাই একান্ত বাধ্য হয়েই মন ইবাদত-বন্দেগির দিকে ঝোঁকে পড়ে। সেই সময় ইবাদত-বন্দেগি করা, মসজিদে পড়ে থাকা খুব সহজ। তাই যৌবনকালের ইবাদাত আর বুড়ো বয়সের ইবাদত কখনো সমান হতে পারে না। আল্লাহ তা’লার কাছে এই যৌবনকালের ইবাদত বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। তাই তো আল্লাহ তা’লা ইবাদত গুযার যুবকদেরকে তাঁর আরশের ছায়ায় আশ্রয় দেয়ার ওয়াদা করেছেন, বুড়োদের নয়।
জীবনের সকল সময়ের মধ্যে যৌবনকালের গুরুত্ব আল্লাহ তা’লার নিকট যে অত্যাধিক বেশি তা আরেকটি হাদিস দ্বারা সহজে বোঝে আসে। সুনানে তিরমিজির এক হাদিসে আল্লাহর রাসূল সা. এরশাদ করেন-
عَنْ ابْنِ مَسْعُودٍ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَا تَزُولُ قَدَمُ ابْنِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ عَنْ عُمُرِهِ فِيمَ أَفْنَاهُ وَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَ أَبْلَاهُ وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ وَمَاذَا عَمِلَ فِيمَا عَلِمَ
অনুবাদ- “কিয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কোন বান্দাই আল্লাহ তা’লার সামনে থেকে এক কদম সামনে বাড়তে পারবে না। এক. সমগ্র জীবন কিসে ব্যয় করেছো? দুই. বিশেষত যৌবনকাল কোন কাজে কাটিয়েছ? তিন. কোন ধরনের উৎস থেকে সম্পদ উপার্জন করেছ? চার. কোন ধরনের খাতে উপার্জিত সম্পদ খরচ করেছ? পাঁচ. ইলম অনুযায়ী আমল করেছ কিনা?” (সুনানে তিরমিজী-৪/৬১২)
উক্ত হাদীসের আলোকে কেয়ামতের ময়দানে মানুষ যে পাঁচটি প্রশ্নের সম্মুখীন হবে তার মধ্যে দুটি হল জীবন সম্পর্কে। দুটি হল সম্পদ সম্পর্কে। আর একটি হল আমল সম্পর্কে। জীবন সম্পর্কে দুটি প্রশ্নের প্রথমটি হল- সমগ্র জীবন তুমি কিসে ব্যয় করেছ? আর দ্বিতীয় প্রশ্নটি হল- সমগ্র জীবনের মধ্যে বিশেষভাবে যৌবনকাল তুমি কি ধরনের কাজে কাটিয়েছ? তাহলে একথা স্পষ্ট যে, আল্লাহ তা’লার নিকট সমগ্র জীবনের মধ্যে যৌবনকাল এক বিশেষ গুরুত্বের দাবী রাখে। শুধু আল্লাহ তা’লার নিকটই নয়, বরং দুনিয়ার দিকে তাকালেও আমরা দেখতে পাই সকল মানুষের মাঝে যুবকদের কদর বেশি। যুব শ্রেণীর গুরুত্ব বেশি। শ্রমিক বা মজদুর খুঁজতে গেলেও দেখে যুবক কিনা, তাগড়া কিনা! বুড়ো হলে মানুষ সহজে কাজে নিয়োগ দিতে চায় না।
আজ বর্তমান সমাজে আল্লাহ তা’লার ইবাদতের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা হয়ে গেছে উল্টো। পরিবারের বুড়ো লোকগুলো দিনরাত আল্লাহ তা’লার ইবাদত বন্দেগিতে লিপ্ত। আর যুবক ছেলে মেয়েগুলো দুনিয়ার মাস্তিতে লিপ্ত। ফজরের সময় বুড়ো বাবা কষ্ট করে ঘুম থেকে উঠে অজু করে মসজিদে আসে নামাজ পড়তে। আর যুবক ছেলেটা বেঘোরে ঘুমায়। বাবাও চিন্তা করে, আর কটা দিন যাক, বয়স হোক তারপর না হয় নামাজ-কালাম পড়বে। অথচ আল্লাহ তা’লার কাছে এই বুড়োর নামাজের চেয়ে ঐ যুবকের নামাজের গুরুত্ব ও মর্যাদা বেশি। ঐ যুবকের ইবাদতের জন্য আল্লাহ তা’লা কিয়ামতের ময়দানে আরশের প্যান্ডেলের নীচে স্থান নির্ধারণ করে রেখেছেন, ঐ বুড়োর জন্য নয়। তাই ইসলাম যুবক সমাজকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। যুব শ্রেণীর মাধ্যমেই সম্ভব ইসলামের প্রচার-প্রসার। যুবকরাই পারে ইসলামকে সঠিকভাবে আঁকড়ে ধরতে। বিশ্ব দরবারে ইসলামকে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে মুসলিম যুবক শ্রেণীর কোন বিকল্প নেই।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, মুসলিম যুব সমাজের গুরুত্ব আমরা না বুঝলেও বিধর্মীরা ঠিকই বোঝে। তারা জানে মুসলিম যুব সমাজ বিশ্বে বিপ্লব সৃষ্টি করতে পারে। মুসলিম যুবক শ্রেণী যদি একবার ঈমানী চেতনায় জেগে উঠতে পারে তাহলে পৃথিবীতে বিধর্মীদের দৌড়াত্ম শেষ হয়ে যাবে। এই জন্য যুগে যুগে ইহুদী-খৃষ্টানরা মুসলিম যুবকদের ঘুম পাড়িয়ে রাখার জন্য তৎপর। মুসলিম যুবকদের থেকে ঈমানী চেতনা বিলুপ্ত করে দুনিয়াবি মোহ, পার্থিব কামনা-বাসনা জাগিয়ে দেয়ার জন্য হেন চেষ্টা নেই যা তারা করে না। মুসলিম সমাজে অশ্লীল ছবি, মুভি ইত্যাদির প্রচার-প্রসার মূলত এগুলোর নমুনা। মুসলিম যুবকদের ঈমান ও ইসলাম থেকে দূরে রাখার জন্য বিধর্মীদের এমনই একটি পদক্ষেপ হল- মুসলিম দেশগুলোতে ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’, ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে বা বিশ্ব ভালবাসা দিবস’ এর মত অশ্লীল ও নগ্ন দিপসের উদযাপন কর্মসূচী।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। জীবনের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে কোন্ কাজটা করা যাবে আর কোন্টা যাবে না, তা ইসলামে বলে দেয়া হয়েছে। কোন্ দিবসটা পালন করা যাবে আর কোন্টা যাবে না ইসলামে তার মূলনীতি চিহ্নিত করা আছে। ইসলাম হল কমপ্লিট কোড অফ লাইফ। পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। কুরআনের সূরা মায়েদায় আল্লাহ তা’লা ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা সম্পর্কে ঘোষণা দেন-
الْيَوْمَ أَكْمَلْت لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْت عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيت لَكُمْ الْإِسْلَامَ دِينًا
অনুবাদ- “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। এবং তোমাদের উপর আমার নিয়ামতকে পূর্ণ করে দিলাম। এবং তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে ইসলামকে মনোনীত করলাম।” (সূরা মায়েদা-৩)
অন্যান্য ধর্মের সাথে ইসলামের পার্থক্যটা এখানেই। অন্যান্য ধর্ম শুধু কিছু উপাসনা আর আনুষ্ঠানিকতার নাম। জীবনের সব কিছু তাদের ধর্মে উল্লেখ নেই। এই জন্য জীবনের অনেক নির্দেশনাই তাদেরকে ভিন্ন মতবাদ বা ধর্ম থেকে হায়ার করে চলতে হয়। কিন্তু ইসলাম মানুষের জীবনের প্রতিটা মুহূর্তের নির্দেশনাও দিয়ে রেখেছে। তাই কোন মুসলমানের জন্য ইসলাম ছাড়া ভিন্ন কোন ধর্ম বা মতবাদ বা কোন রীতি-নীতি গ্রহণ করা কোনভাবেই বৈধ হবে না। সূরা বাকারায় আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন-
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ (سورة آل عمران
অনুবাদ- “আর যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন গ্রহণ করবে সেটা কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না। আর আখেরাতে সে ক্ষতিগ্রস্ত বলে গণ্য হবে।” (সূরা -৮৫)
সুতরাং কোন নতুন দিবসের সূচনা হলে, কোন নতুন নীতি বা মতবাদের আবির্ভাব হলে প্রথমেই দেখতে হবে এ সম্পর্কে ইসলাম কী বলে? এই দিবস ইসলাম অনুমোদন করে কিনা? এই মতবাদ বা মতাদর্শ ইসলাম সাপোর্টেড কিনা? তাই তথাকথিত বিশ্ব ভালবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইন’স ডে পালনের আগে জানতে হবে ইসলাম এই দিবস পালন করার অনুমতি দেয় কিনা? তাই প্রথমেই জানতে হবে, বিশ্ব ভালবাসা দিবসের ইতিহাস কী? কোত্থেকে এই দিবসের আমদানি এবং কী এর উদ্দেশ্য? সর্বশেষ ইসলামে এই দিবস পালনে বৈধতা কতটুকু?
ভ্যালেন্টাইন’স ডে’র ইতিহাস:
বিশ্ব ভালবাসা দিবসের ইতিহাস সম্পর্কে অনেকগুলো মত পাওয়া যায়। কবে এই দিবসের সূচনা হয়েছিল এ ব্যপারে একাধিক মত থাকলেও সবচে’ নির্ভরযোগ্য ও প্রতিষ্ঠিত মতটি দিয়েছেন কলোরাডা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান গবেষক, অধ্যাপক নিওল লেন্সিক। তার মতে- এই দিবসটির সূচনা হয়েছিল হযরত ঈসা আ. এর জন্মেরও চারশত বছর আগে খৃষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে। সে সময় রোমানদের ধর্ম ছিল প্যাগান বা পৌত্তলিক ধর্ম। মূর্তি পুজা আর পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসী ছিল তারা। বিভিন্ন দেব দেবীর পূজা করত। হিন্দুদের মত রোমানরাও বহু ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিল। একেকটা বিষয়ের জন্য একেকজন দেবতাকে তারা কল্পনা করত । সৃষ্টির জন্য একজন দেবতাকে কল্পনা করত। বৃষ্টির জন্য বিশ্বাস করত ভিন্ন দেবতায়। আবার জমির উর্বরতার জন্য কল্পনা করত অন্য দেবতাকে। এমনিভাবে বন্য পশু-পখির জন্য ‘লুপারকাস’ (Lupercus) নামে একজন দেবতাকে তারা বিশ্বাস করত। এই দেবতার প্রতি ভালবাসা জানিয়ে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারীর ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে তারা একটা ধর্মীয় পুজার উৎসব করত। তারমধ্যে ১৪ ই ফেব্রুয়ারী ছিল মূল অনুষ্ঠান। এই উৎসবের নাম ছিল ‘লুপারক্যালিয়া’ (Lupercalia)।
এই পুজা উৎসবের প্রধান আকর্ষণ ছিল লটারি। যুবতীদের নামে লটারি ইস্যু করা হত। লটারিতে যে যুবতী যে যুবকের ভাগে পড়ত আগামী বছর এই দিন আসা পর্যন্ত সে যুবতীকে ঐ যুবক ভোগ করত। অর্থাৎ যুবতীদেরকে উপভোগ্য পণ্য হিসেবে লটারির মাধ্যমে এক বছরের জন্য যুবকদের মাঝে বন্টন করে দেয়া হত। ১৪ই ফেব্রুয়ারী’র এই ‘লুপারক্যালিয়া’ পুজা উৎসবের আরেকটা প্রথা ছিল, দেবতার নামে তারা পশু উৎসর্গ করত। উৎসর্গকৃত ছাগলের চামড়া তুলে যুবতীর গায়ে জড়িয়ে দেয়া হত। এরপর ছাগল ও কুকুরের রক্ত মিশ্রিত একটি চাবুক দ্বারা যুবক ঐ চামড়া পরিহিতা যুবতীকে আঘাত করত। তারা মনে করত এই চাবুকের আঘাতের কারণে যুবতীটি গর্বধারণে সক্ষমতা লাভ করবে।
এরপর হযরত ঈসা আ. এর আগমন হল। খৃষ্ট ধর্মের আবির্ভাব হল। যেহেতু খৃষ্ট ধর্ম ছিল ‘আহলে কিতাবে’র ধর্ম। তারা এধরণের পৌত্তলিক কুসংস্কারে বিশ্বাস করত না। তাই তারা এর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করল। কিন্তু নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য জনগনের পৌত্তলিক সংস্কৃতিকে পুরোপুরি বাদ দিতেও পারল না। তাই বাধ্য হয়ে এই অনুষ্ঠানকে খৃষ্ট ধর্মের ব্যানারে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করল। অনুষ্ঠান ঠিক থাকবে, তবে একটু বিশুদ্ধ করা হবে। ধর্মের লেভেল লাগানো হবে। আগে যুবক-যুবতীদের মাঝে লটারী করা হত। এখন লটারি করা হবে যুবক-পাদ্রীদের মাঝে। যে যুবকের নাম যে পাদ্রীর সাথে পড়বে সে ঐ পাদ্রীর সোহবতে এক বছর কাটাবে। এভাবে পাদ্রীর সংস্পর্শে যুবকের আখলাক ও চরিত্র সংশোধন হবে। এভাবে পৌত্তলিক রোমানদের কুসংস্কার খৃষ্ট ধর্মের লোকেরা ধর্মের মোড়কে নতুন উৎসবের রূপ দিল। এবং ৪৭৬ সনে পোপ জুলিয়াস প্রস্তাব করলেন, এবার দিবসের নামও পরিবর্তন করা হোক। আগে ছিল রোমান গড লুপারকাসের নামে, এবার হবে কোন খৃষ্টান সাধু বা সেন্টের নামে। যাতে পৌত্তলিকতার কোন চিহ্ন অবশিষ্ট না থাকে। সে সময় রোমান খৃষ্টানদের মাঝে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন’ নামে একজন সাধু ছিল। তার নামানুসারে ৪৯৬ খৃষ্টাব্দে পোপ জুলিয়াস দিবসটির নামকরণ করে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন’স ডে’। এভাবেই পৌত্তলিকদের ‘লুপারক্যালিয়া’ পুজা উৎসব খৃষ্টানদের ‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে’ তে রূপান্তর হয়।
(তথ্যসূত্রঃ বাংলামেইল- http://www.banglamail24.com/news/2015/02/14/id/150685, মিম্বারের ধ্বনি :লেখক-মাহমুদুল হাসান)
সেন্ট ভ্যালেন্টাইন কে?
এখন প্রশ্ন জাগে, খৃষ্টান সাধু এই সেন্ট ভ্যালেন্টাইন কে? ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, খৃষ্টান সেন্টদের মধ্যে দুজন ভ্যালেন্টাইন বেশ পরিচিত। তবে যার নামে এই ভ্যালেন্টাইন’স ডে নামকরণ করা হয় তার সম্পর্কে জানা যায়- সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ছিলেন একজন খৃষ্টান ধর্ম যাজক এবং অভিজ্ঞ চিকিৎসক। খৃষ্ট ধর্ম প্রচারের দায়ে ২৬৯ সালে রোমান পৌত্তলিক রাজা দ্বিতীয় ক্লাডিয়াস তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। কারাবন্দী হওয়ার পর বিভিন্ন তরুণ-তরুণীরা তাকে ভালোবেসে কারাগারের জানালা দিয়ে চিরকুট লিখে নিক্ষেপ করত। সে সময় কারা রক্ষীর অন্ধ মেয়ে জুলিয়ার সাথে ভ্যালেন্টাইনের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। ভ্যালেন্টাইন জুলিয়াকে চিকিৎসার মাধ্যমে দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দেয়। এবং তাকে খৃষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করেন। রাজা ক্লাডিয়াস এসব জানতে পেরে তাকে প্রকাশ্যে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলায়। মৃত্যুর আগে ভ্যালেন্টাইন জুলিয়ার জন্য একটি চিরকুট লিখে যায়। যাতে লেখা ছিল- ‘From your Velantine’ (তোমার ভ্যালেন্টাইনের পক্ষ থেকে)। এই জন্য এই যাজক খৃষ্টান সমাজে ‘প্রেমিকদের যাজক’ উপাধি লাভ করে। বলা হয়ে থাকে ভ্যালেন্টাইনকে যেদিন ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হয় সেদিনটিও ছিল ১৪ ই ফেব্রুয়ারী। তাই ৪৯৬ সালে পোপ জুলিয়াস ১৪ই ফেব্রুয়ারী পালিত হওয়া পৌত্তলিকদের ‘লুপারকালিয়া’ উৎসবের নাম পরিবর্তন করে ‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে’ নামকরণ করে। এবং যেহেতু এই ধর্ম যাজক ‘প্রেমিকদের যাজক’ উপাধি লাভ করেছিল এই জন্য এই দিনটিকে বিশ্ব ভালবাসা দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়ে থাকে।
(তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া’- https://bn.wikipedia.org/wiki/fv‡jvevmv_w`em, ‘মিম্বারের ধ্বনি’: লেখক-মাহমুদুল হাসান,
বাংলাদেশে ‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে’র সূচনাঃ
বাংলাদেশে সর্ব প্রথম ‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে’র সূচনা হয় ১৯৯৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারী। তখনকার সাপ্তাহিক ‘যায়যায় দিন’ পত্রিকার সম্পাদক শফিক রেহমান তার পত্রিকার মাধ্যমে এই দিবসকে বাংলার যুব সমাজের কাছে সর্ব প্রথম তুলে ধরে। ভ্যালেন্টাইন’স ডে উপলক্ষ্যে বিশেষ প্রতিবেদন বের করে। তখনই সর্ব প্রথম বাংলার মানুষ এই ভ্যালেন্টাইন’স বা ভালবাসা দিবস সম্পর্কে জানতে পারে। এরপর মিডিয়া আর ব্যবসায়ীদের যৌথ উদ্যোগে এই দিবস অবৈধ প্রেম-ভালবাসা প্রকাশের এক নোংরা আর অশ্লীল সংস্কৃতির রূপ লাভ করেছে।
কে এই শফিক রেহমান?! দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দীর্ঘদিন পর্যন্ত শফিক রেহমান পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে কর্মরত ছিল। বিশেষত আশির দশকে এরশাদের শাসনামলে দীর্ঘ ছয় বছর লন্ডনে নির্বাসিত ছিল। সে সময় সে ইউরোপ-আমেরিকার অন্যান্য সংস্কৃতির মত এই নোংরা সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়। এবং ১৯৯২ সালে দেশে এসে তার সাপ্তাহিক পত্রিকাকে জনপ্রিয় করা এবং এই অশ্লীল সংস্কৃতিকে যুব সমাজের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে ১৯৯৩ সালে ‘যায়যায় দিনে’র বিশেষ প্রতিবেদন বের করে। এরপর থেকে অবৈধ ভালবাসার এই নোংরা সংস্কৃতিকে ব্যপকভাবে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ‘মৌচাকে ঢিল’ ম্যাগাজিন ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘লাল গোলাপ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই সংস্কৃতির প্রচার করে আসছে। আজ বাংলাদেশে তাকে ভালবাসা দিবসের জনক হিসেবে পরিচয় দেয়া হয়।
(তথ্যসূত্রঃ ‘প্রেসবার্তা’ অনলাইন সস্করণ- http://www.pressbarta.com/archives/2240, উইকিপিডিয়া’- https://bn.wikipedia.org/wiki/kwdK_ †ingvb)
কিন্তু অনুতাপের বিষয় হল, শফিক রেহমান বাংলাদেশে পাপ ও অন্যায়ের এমন এক দ্বার উন্মোচন করেছে, যার গোনাহ কিয়ামত পর্যন্ত তার আমলনামায় জমা হতে থাকবে। বাংলাদেশে যত মানুষ এই দিবস পালন করবে, যত যুবক এই দিবসে যত গোনাহ করবে সকল গোনাহের সমপরিমাণ গোনাহ শফিক রেহমানের আমালনামায় যোগ হতে থাকবে। অনেকটা চেইন রিএ্যাকশনের মত। কিয়ামত পর্যন্ত চলতেই থাকবে এবং পরিধি ব্যপকতা লাভ করতেই থাকবে। এই সম্পর্কে এক হাদিসে আল্লাহর রাসূল সা. এরশাদ করেন-
مَنْ سَنَّ سُنَّةً حَسَنَةً فَعُمِلَ بِهَا كَانَ لَهُ أَجْرُهَا وَمِثْلُ أَجْرِ مَنْ عَمِلَ بِهَا لاَ يَنْقُصُ مِنْ أُجُورِهِمْ شَىْءٌ ، وَمَنْ سَنَّ سُنَّةً سَيِّئَةً فَعُمِلَ بِهَا كَانَ لَهُ وِزْرُهَا وَمِثْلُ وِزْرِ مَنْ عَمِلَ بِهَا لاَ يَنْقُصُ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَىْءٌ
অনুবাদ- “যে ব্যক্তি অনুকরণীয় ভাল কোন কাজের সূচনা করবে, সে এই কাজের প্রতিদান তো পাবেই, এমনকি যারা তার অনুসরণ করে এই কাজ করবে তাদের আমলের প্রতিদানের অংশও সে পাবে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি অনুসরণযোগ্য কোন মন্দ কাজের সূচনা করবে, সে ঐ মন্দ কাজের শাস্তি তো ভোগ করবেই, পাশাপাশি তার এই পথ অনুসরণ করে যারা এই মন্দ কাজে লিপ্ত হবে তাদের মন্দ কাজের শাস্তিও সে ভোগ করবে।” (সুনানে ইবনে মাজাহ-২০৭)
আফসোস হয় এসকল শফিক রেহমানদের জন্য। যারা দুনিয়াতে হিরো হওয়ার জন্য, মানুষের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার জন্য এমন এমন মন্দ কাজের সূচনা করে যাচ্ছে, যার ভোগান্তির শেষ নেই। কিয়ামতের দিন নিজের অপরাধের বোঝ নিয়েই মানুষ পেরেশান থাকবে। ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি জপতে থাকবে, সেখানে যদি আরো হাজার হাজার মানুষের পাপের বোঝা নিতে হয় তাহলে তো মুক্তির কোন সম্ভাবনাই থাকে না। আল্লাহ মাফ করুন এবং এমন পাপের সূচনা থেকে আমাদেরকে হেফাজত করুন।
ইসলামে ‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে’ পালনের বিধানঃ
ভ্যালেন্টাইন’স ডে’র উৎপত্তি, ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ জানার পর এটা সুস্পষ্ট যে, এই দিবসটি মূলত তিনটি ধাপ অতিক্রম করে বর্তমান রূপ পেয়েছে। প্রথমে এটি ছিল রোমান পৌত্তলিকদের একটা পুজা উৎসব- ‘লুপারক্যালিয়া’। তাই দিবসটির নামকরণও হয়েছিল একজন রোমান দেবতা ‘লুপারকাসে’র নামে। দ্বিতীয় ধাপে এটি খৃষ্টানদের মাধ্যমে একটি খৃষ্ট ধর্মীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। তাই দিবসটির নামকরণও হয়েছে একজন খৃষ্টান ধর্ম যাজক ‘ভ্যালেন্টাইনে’র নামে। তৃতীয় ধাপে বর্তমানে এসে এটি একটি বিবাহ পূর্ব অবৈধ প্রেম-ভালবাসা প্রকাশের নোংরা সংস্কৃতির রূপ লাভ করেছে।
এখন প্রশ্ন হল- মুসলমানদের জন্য এই ভ্যালেন্টাইন’স ডে পালন করার বিধান কী? উপরে দিবসটির যে তিনটি ধাপ আমরা লক্ষ্য করলাম তাতে দেখা যাচ্ছে যে, তিনটা ধাপের প্রতিটি ধাপই ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ, ভিন্ন ধর্মের কোন ধর্মীয় সংস্কৃতি গ্রহণ করা বা তাদের কোন ধর্মীয় উৎসবে যোগ দেয়া ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। এ ব্যপারে রাসূল সা. এক হাদিসে এরশাদ করেছেন-
وَعَنْ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ :مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ أَخْرَجَهُ أَبُو دَاوُد وَصَحَّحَهُ ابْنُ حِبَّان
অনুবাদ- “যে ব্যক্তি ভিন্ন কোন জাতির অনুকরণ করে (পেশাক-পরিচ্ছেদ, রীতি-নীতি বিশেষত তাদের ধর্মীয় কোন পুজা-উৎসবের অনুকরণ করে) তাহলে সে ঐ জাতির অন্তর্ভূক্ত হবে। এবং হাশরের দিন সে ঐ জাতির সাথে হাশর-নাশর করবে।’’ (মুসনাদে আহমাদ-২/৫০, সুনানে আবু দাউদ-৪০৩৩)
আর বর্তমান ভালবাসা দিবস মূলত বিয়ে বহির্ভূত অবৈধ প্রেম-ভালোবাসা প্রকাশের একটি নোংরা সংস্কৃতি। তাই এই দিবস কোন মুসলমানের জন্য পালন করা কোন ভাবেই বৈধ হবে না। কেননা কোরআনে কারিমে আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেছেন-
وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا
অনুবাদ- “তোমরা ব্যভিচারের নিকটেও যেয়ো না। অবশ্যই এটা অশ্লীল কাজ ও নিকৃষ্ট পন্থা।” (সূরা বনী ইসরাঈল-৩২)
এই আয়াতে আল্লাহ তা’লা বলেছেন তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। এ কথা বলেন নি যে, তোমরা ব্যভিচার করো না। এর মর্মার্থ হল- তোমরা ব্যভিচার তো করবেই না, এমনকি ব্যভিচারের দিকে আকর্ষণ করে, ব্যভিচারে উদ্বুদ্ধ করে, যিনার পথে প্ররোচিত করে এমন কোন কাজও করো না। তাই স্বামী-স্ত্রীর প্রেম-ভালবাসা ছাড়া পর পুরুষ বা পর নারীর সাথে প্রেম-ভালবাসা ইসলাম অনুমোদন করে না। বরং ইসলামের দৃষ্টিতে এগুলো হল নোংরা ও অশ্লীল কর্মকা-। এমনকি পর পুরুষ বা পর নরীর দিকে তাকানো, কথা বলা, অন্তরে তাকে নিয়ে কুচিন্তা করা এগুলোও ইসলামের দৃষ্টিতে যিনা বা ব্যভিচারের সমতুল্য। এক হাদিসে আল্লাহর রাসূল সা. এরশাদ করেন-
حديث أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم: إِنَّ اللهَ كَتَبَ عَلَى ابْنِ آدَمَ حَظَّهُ مِنَ الزِّنَا أَدْرَكَ ذَلِكَ، لاَ مَحَالَةَ فَزِنَا الْعَيْنِ النَّظَرُ، وَزِنَا اللِّسَانِ الْمَنْطِقُ وَالنَّفْسُ تَمَنَّى وَتَشْتَهِي وَالْفَرْجُ يُصَدِّقُ ذَلِكَ وَيُكَذِّبُهُ (أخرجه البخاري)
অনুবাদ- “চোখের যিনা হচ্ছে তাকানো, জিহ্বার যিনা হচ্ছে কথা বলা, অন্তর তা কামনা করে এবং পরিশেষে যৌনাঙ্গ একে বাস্তবায়ন করে অথবা পরিত্যাগ করে।” (সহীহ বুখারি-৬২৩৮, সহীহ মুসলিম-২৬৫৭)
আর অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা হল শয়তানের অস্ত্র। সমাজে ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করা এবং মানুষকে জাহান্নামে নেয়ার জন্য শয়তান মানুষকে অশ্লীলতার আদেশ করে, নোংরামির পথে প্ররোচিত করে। কোরআনে কারিমে সূরা বাকারায় আল্লাহ তা’লা উল্লেখ করেন-
وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ إِنَّمَا يَأْمُرُكُمْ بِالسُّوءِ وَالْفَحْشَاءِ
অনুবাদ- “আর তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। সে তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। সে তো তোমাদের নির্দেশ দেয় মন্দ ও অশ্লীল কাজ করতে।” (সূরা বাকারা-১৬৮, ১৬৯)
সুতরাং ভ্যালেন্টাইন’স ডে-এর ইতিহাস ও তা পালন করার শরয়ী বিধান জানার পর এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কি শরয়ী নিষেধ অমান্য করে পশ্চিমাদের এই নোংরা সংস্কৃতিকে ধুমধামে উদযাপন করবো নাকি আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের বিধান মেনে এসব নোংরামি ছেড়ে দিবো!! ইসলাম হল একটি যুগোপযোগী সর্বজনীন সমৃদ্ধ ধর্ম। এই ধর্মের অনুসারীরা অন্য ধর্মের বা অন্য জাতির চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাবান। এই শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা আল্লাহ তা’লাই দিয়েছেন। তিনি এরশাদ করেছেন, “আর তোমরা হলে সকল জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ জাতি। তোমাদেরকে সৃষ্টিই করা হয়েছে মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য। তোমরা মানুষকে আদেশ করবে ভাল কাজের এবং নিষধ করবে মন্দ কাজ থেকে।” (সূরা আল-ইমরান: ১১০)। সুতরাং এমন শ্রেষ্ঠ ও মর্যদাবান জাতি কিভাবে বিভ্রান্ত একটি জাতির নোংরা সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে পারে!? কিন্তু এতদসত্বেও ১৪ই ফেব্রুয়ারী মুসলিম যুব সমাজকে দেখা যাবে এই ভালবাসা দিবস সাগ্রহে উদযাপন করছে। হাতে গোলাপ ফুল আর ভালবাসার কার্ড নিয়ে শহরের রাস্তায় ঘুরাফেরা করছে। মুসলিম যুবতীদের দেখা যাবে লাল শাড়ি পরে প্রায় দিগম্বর হয়ে এই নোংরা সংস্কৃতি পালন করছে।
শুধু ভ্যালেন্টাইন’স ডে নয়; বরং থার্টি ফার্স্ট নাইট, বার্থ ডে, বড় দিনসহ পাশ্চাত্ব সভ্যতা থেকে ইহুদী-খৃষ্টানদের আমদানী করা প্রতিটি নোংরা ও অশ্লীল সংস্কৃতিকে আজ মুসলমানরা সাড়ম্বরে উদযাপন করে। এক্ষেত্রে ইসলামের বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা করছে না কেউ। যেন ইহুদী খৃষ্টানদের অনুসরণে মুসলমানরা আজ প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আজকের এই পৃথিবীর কথা চিন্তা করেই চৌদ্দশ বছর আগে আল্লাহর রাসূল সা. বলে গিয়েছেন-
حديث أَبِي سَعِيدٍ الْخدْرِيِّ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم، قَالَ: لَتَتْبَعُنَّ سَنَنَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ، شِبْرًا بِشِبْرٍ، وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ حَتَّى لَوْ دَخَلُوا جُحْرَ ضَبٍّ تَبِعْتُمُوهُمْ قُلْنَا: يَا رَسُولَ اللهِ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى قَالَ: فَمَنْ
অনুবাদ- “একসময় অবশ্যই তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরবে প্রতি বিঘতে, প্রতি গজে (অর্থাৎ- প্রতি মুহূর্তে, প্রতি পদক্ষেপে)। এমনকি তারা যদি কোন প্রাণীর (ষা-ার) গর্তে গিয়ে প্রবেশ করে তাহলে তাদের অনুসরণ করে তোমরাও সেই গর্তে গিয়ে প্রবেশ করবে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ‘পূর্ববর্তী’ বলতে কি ইহুদী-নাছারা বুঝিয়েছেন? আল্লাহর রাসূল বললেন, তাহলে আর কে?!” (সহীহ বুখারী-৭৩২০)
চৌদ্দশ বছর আগে যখন আল্লাহর রাসূল সা. এই হাদীস বলেছেন তখন মুসলমানরা ইহুদী-খৃষ্টানদের অনুসরণ করবে এটা ছিল কল্পনাতীত। কারণ, ইসলামের তখন জয়জয়কার। স্বয়ং ইহুদী-খৃষ্টানরাও দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিল। তখন ইসলামই ছিল সকলের কাছে আইডল, আদর্শ। ইসলাম বাদ দিয়ে, মুসলামানদের বাদ দিয়ে অন্য কোন ধর্ম বা জাতিকে অনুসরণ করবে এটা মুসলমানরাও যেমন কল্পনা করতে পারত না, তেমনি অন্য ধর্মের লোকেরাও কল্পনা করতে পারত না। সেই সময় আল্লাহর রাসূল মুসলমানদেরকে উদ্দেশ্য করে বলে গিয়েছেন, অচিরেই এমন এক সময় আসবে যখন তোমরা ইসলাম ছেড়ে এই ইহুদী-খৃষ্টানদেরকে অনুসরণ করবে। তাদের প্রতিটি সংস্কৃতিকে সাদরে আমন্ত্রণ জানাবে। যেন আজকের এই পৃথিবীকে আল্লাহর রাসূল চৌদ্দশ বছর আগে চোখের সামনে দেখে দেখে এই হাদীস বর্ণনা করেছিলেন।
পরিশেষে যুবক ভাইদের সাথে সাথে, অভিভাবকদেরকেও বলছি- আসন্ন ভ্যালেন্টাইন’স ডে উপলক্ষ্যে আপনাদেরও কিছু করণীয় আছে। কিছু দায়িত্ব আছে। আপনার ছেলে বা মেয়ে যেন এই দিবস উদযাপন না করে, এই ভ্যালেন্টাইন’স ডে’র নোংরা স্রোতে যেন আপনার সন্তান ভেসে না যায় এই খেয়াল রাখা আপনার দায়িত্ব। এই দায়িত্ব আমার পক্ষ থেকে নয়। আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের পক্ষ থেকে। এক হাদিসে আল্লাহর রাসূল সা. এরশাদ করেন-
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ :« أَلاَ كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ فَالأَمِيرُ رَاعٍ عَلَى النَّاسِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ وَالرَّجُلُ رَاعٍ عَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ وَامْرَأَةُ الرَّجُلِ رَاعِيَةٌ عَلَى بَيْتِ بَعْلِهَا وَوَلَدِهِ وَهِىَ مَسْئُولَةٌ عَنْ بَعْلِهَا وَرَعِيَّتِهَا وَالْعَبْدُ رَاعٍ عَلَى مَالِ سَيِّدِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ أَلاَ وَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ »
অনুবাদ- “শোনে রাখো! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। আর প্রত্যেকেই তার অধীনস্তদের ব্যপারে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব শাসক তার প্রজাদের ব্যপারে দায়িত্বশীল। সুতরাং সে তার প্রজাদের ব্যপারে জিজ্ঞাসিত হবে। এবং প্রতিটি ব্যক্তি তার পরিবারের ব্যপারে দায়িত্বশীল। সুতরাং সে তার পরিবারের ব্যপারে জিজ্ঞাসিত হবে। আর স্ত্রীরা তার স্বামীর সংসার ও সন্তানদের ব্যপারে দায়িত্বশীল। সুতরাং সে জিজ্ঞাসিত হবে তার সংসার ও সন্তানদের ব্যপারে। আর ক্রীতদাস তার মনিবের সম্পদের ব্যপারে দায়িত্বশীল। সুতরাং সে জিজ্ঞাসিত হবে তার দায়িত্বের ব্যপারে। আবার শোনে রাখো! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। আর প্রত্যেকেই তার অধীনস্তদের ব্যপারে জিজ্ঞাসিত হবে।” (সহীহ বুখারী-৪৮২৮ , সহীহ মুসলিম-৩৪১৪)
আল্লাহ তা’লা আমাদের প্রত্যেককে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন। এই সকল নোংরা ও অশ্লীল অপসংস্কৃতি থেকে সর্বাত্মকভাবে বেঁচে থাকার তৌফিক দান করুন। আমিন।
১২ফেব্রুয়ারী ’১৬, শুক্রবার
আল হেরা জামে মসজিদ
জিগাতলা, ধানমন্ডি, ঢাকা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন