তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস


তাকদীর শব্দটির আভিধানিক অর্থ হল পরিমাণ নির্ধারন করা।  পরিভাষায় তাকদীর বলা হয় আল্লাহ তালার পক্ষ থেকে প্রত্যেক সৃষ্টির ভাল-মন্দ সকল বিষয় নির্ধারন করা।  অর্থাৎ সৃষ্টি জগতের কে কখন জন্ম গ্রহণ করবে, কখন কার মৃত্যু কোথায় হবে, কিভাবে হবে, কার কী আমল ও দায়িত্ব হবে, কার রিযিক কোত্থেকে আসবে, কিভাবে আসবে ইত্যাদি সকল বিষয় আল্লাহ তায়ালা মহাবিশ্ব সৃষ্টির বহু পূর্বেই নির্ধারণ করে রেখেছেন।  মহাবিশ্বে ইতিপুর্বে যা ঘটেছে, বর্তমানে যা ঘটছে এবং ভবিষ্যতে যা ঘটবে সবই আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্ধারিত এবং লিপিবদ্ধ। আল্লাহ তালার এই নির্ধারণকে ইসলামের পরিভাষায় তাকদীর বলা হয়।  
তাকদীর সম্পর্কে কুরআনে কারীমের সূরা ফুরকানে ইরশাদ হয়েছে,
وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ فَقَدَّرَهُ تَقْدِيرًا (2)
আর তিনিই সব কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং সেগুলোর তাকদীর বা পরিমাণও নির্ধারণ করেছেন যথাযথভাবে।(সূরা ফুরকান, আয়াত-)

তাকদীরের প্রতি ঈমান আনা এবং তার ভাল-মন্দের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয এটা এমন এক ইসলামী বিশ্বাস যার মধ্যে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।  তাই আমরা বিশ্বাস করি যে, পৃথিবীতে যা কিছুই ঘটছে এসব কিছুই  পূর্বেই লেখা হয়ে গেছে।  আল্লাহ তায়ালা সমগ্র বিশ্ব জগত সৃষ্টি করেছেন।  আসমান, যমীন, জীবজন্তু, মানুষ, বৃক্ষ, তরুলতা সবই আল্লাহর সৃষ্টি।  আল্লাহ তায়ালা এসব কিছু সৃষ্টি করার আগেই এসব কিছু তাঁর জ্ঞানের মধ্যে ছিলো।  কাজেই যা কিছু পৃথিবীতে ঘটে সবই আল্লাহর জ্ঞান এবং ইচ্ছা অনুযায়ী ঘটে থাকে।  আল্লাহ তায়ালা বলেন,
"একটি পাতা কোথাও ঝরে না, যার খবর তিনি জানেন না। মাটির অন্ধকারে একটি শস্যকণাও নেই, নেই কোন তাজা সবুজ (কিংবা ক্ষয়িষ্ণু) শুকানো (কিছু), যার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ একটি সুস্পষ্ট গ্রন্থে মজুদ নেই। (আল আনআম, আয়াত 59)"

তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের ব্যপারে এক হাদীসে এসেছে, হযরত যাবের (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন তোমাদের কেউ ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাকদীরের উপর ঈমান আনবে।  তার ভালোর উপরও এবং মন্দের উপরও।  এমনকি সে বিশ্বাস করবে যে, যা ঘটার ছিলো তাই ঘটেছে এবং যা ঘটার ছিল না তা ঘটেনি’ ( তিরমিযী)
অন্য এক হাদীসে এসেছে, হযরত আবুদ দারদা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে, আল্লাহ তাআলা সমস্ত বান্দার পাঁচটি বিষয়ের ফায়সালা করে দিয়েছেন।  তার বয়সের, তার রিযিকের, তার আমলের, তার কবরের জায়গার এবং পরিণামে সে ভাগ্যবান হবে, না হতভাগা।’ (আহমাদ, বাযযার, কাবীর ও আওসাত)

তবে তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার অর্থ এই নই যে, যেহেতু সৃষ্টিজগতের সকল ভাল-মন্দ আল্লাহ তালা নির্ধারণ করে রেখেছেন তাহলে আমল করে কী লাভ? চেষ্টা-সাধনা করে কী ফায়দা? কেননা বিশ্বজগতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে এসব কিছু সম্পর্কে আল্লাহর জানা থাকা এবং তাকদীরে লেখা থাকা মানুষের চেষ্টা-সাধনা ও আমলের পরিপন্থী নয়।  
এ সম্পর্কে একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, তোমাদের প্রত্যেকের ঠিকানা জান্নাতে অথবা জাহান্নামে লিখা হয়ে গেছে। তখন বলা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তবে কি আমরা আমল বর্জন ছেড়ে দিব না? এবং আমাদের তাকদীরের উপর ভরসা করব না? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে বললেন, না, আমল করতে থাকো। আর প্রত্যেকের জন্য ঐ আমল করা সহজ হবে যার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে (বুখারী ও মুসলিম)
আরেকবার রাসূল সা. কে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, ওষুধের সাহায্যে কি সেসব অসুখ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় যেসব অসুখ তকদিরে লেখা রয়েছে? রসুল (সা.) জবাবে বলেছিলেন, ওষুধ সেবনও তকদিরের লেখার একটি অংশ।কারণ, মানুষ কিভাবে চেষ্টা করবে, চেষ্টার পরিণাম কি হবে, চেষ্টার উপাদান কি হবে সবই তো তাকদীরে লেখা রয়েছে।  সেই চেষ্টা অনুযায়ী ফল পাওয়া যাবে।  যদি কারও তকদিরে সফল হওয়া লেখা থাকে তবে সেসব উপাদানও লেখা রয়েছে, যার মাধ্যমে সফলতা পাওয়া যাবে।  যেমন পরিশ্রম করা, নিজের বুদ্ধি বিবেক ব্যবহার করা ইত্যাদি।  কাজেই চেষ্টা করা তকদিরের পরিপন্থী নয়; বরং এসব কিছুই তকদিরের একটা অংশ।
সিরিয়ায় যখন ব্যপক আকারে মহামারী রূপে প্লেগ দেখা দিয়েছিলো।  হযরত ওমর (রা.) তখন সাহাবাদের সাথে সিরিয়ায় যাচ্ছিলেন, কিন্তু এখবর পাওয়ারপর যাত্রা স্থগিত করেন। একজন সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি কি আল্লাহর লেখা তকদির থেকে পলায়ন করছেন? তিনি বললেন, হাঁ, আমি আল্লাহর লেখা একটি তকদির থেকে অন্য একটি তকদিরের দিকে পলায়ন করছি।  অর্থাৎ, রোগ হওয়া যেমন আল্লাহ তাকদীর তেমনিভাবে রোগ থেকে দূরে চলে যাওয়াও তকদিরের একটি অংশ।
এজন্য তাকদীরের দোহাই দিয়ে আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকবো না, বরং আমাদেরকে অবশ্যই কাজ করতে হবে। উপায়-উপকরণ কাজে লাগাতে হবে।  এসব কিছু তো রসুলুল্লাহ (সা.)ও করেছিলেন, আল্লাহর প্রতি যার বিশ্বাস ছিল সকলের চেয়ে অধিক।  তিনি সেনাবাহিনী তৈরী করেছিলেন, কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন, বর্ম পরিধান করেছিলেন।  হাবশা ও মদিনায় হিজরতের আদেশ দিয়েছিলেন।  হিজরতের সময় গুহায় আত্মগোপন করেছিলেন। নিজের পরিবারের লোকদের জন্য এক বছরের খাদ্যদ্রব্য মজুদ করেছিলেন

সুতরাং তাকদিরের প্রতি বিশ্বাসের অর্থ হচ্ছে, মানুষ প্রথমে কাজ করবে, উপায় উপকরণ গ্রহণ করবে, চেষ্টা সাধনা চালাবে, তারপর পরিণামের ফল আল্লাহর ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেবে।
আবু দাউদের এক হাদীসে এসেছে, একবার মহানবী (সা.) এর সামনে দু'জন সাহাবী কুস্তি প্রতিযোগিতা করলেন।  পরাজিত ব্যক্তি কোন প্রতিদ্বন্দিতা না করেই হেরে গেলো।  হেরে গিয়ে বলল, আল্লাহ তায়ালা আমার সাহায্যকারী, এটা আমার তাকদীর।  রসুল (সা.) একথা শুনে ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেন।  বললেন, প্রথমে পরিশ্রম করে চেষ্টা করো, তারপর পরাজিত হও, তারপর বলবে যে, আল্লাহ তায়ালা আমার সাহায্যকারী (আবু দাউদ)

তকদিরের প্রতি বিশ্বাস রাখার অনেক উপকারিতা আছে।  পার্থিব জীবনে এর সবচেবড় সুফল হচ্ছে যে, মানুষ সকল প্রকার চেষ্টা পরিশ্রম করার পরও যদি পরাজিত হয়, তখন তার মধ্যে হতাশা দেখা দেয় না। বিপদে যখন পড়ে তখন ধৈর্য হারা হয় না।  পরিশ্রম করার পর যা কিছু পায় সেই পাওয়াকে আল্লাহর মর্জি ভেবে সন্তুষ্ট থাকে এবং ধৈর্য ধারণ করে।  আল্লাহর শোকর আদায় করে।  তাকদীরে বিশ্বাসের এই উপকরিতার কথাই কুরআনে কারীমের এই আয়াতে আল্লাহ তালা ইরশাদ করেছেন,
لِكَيْلَا تَأْسَوْا عَلَى مَا فَاتَكُمْ وَلَا تَفْرَحُوا بِمَا آتَاكُمْ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ (23)
যেন তোমরা যা পাওনি তার জন্য দুঃখিত না হও এবং তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তার জন্য উল্লসিত না হও।’ (সূরা হাদীদ-২৩)
তকদিরের প্রতি বিশ্বাস যদি মুসলিম মিল্লাতের অন্তরে জাগ্রত হয়, তবে এমন একটি উম্মত তৈরী হতে পারে, যারা আধ্যাতি্নক দিক দিয়েও হবে শক্তিশালী এবং তাদের মধ্যে চেষ্টা প্রচেষ্টা করার গুণ বৈশিষ্টও থাকবে বিদ্যমান। সেই উম্মত ইতিহাসের গতিধারা পাল্টে দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে
আল্লাহ তালা আমাদেরকে তাকদীরের ভাল-মন্দ সকল বিষয়ের উপর যথাযথ ঈমান আনার এবং দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপনের তাওফীক দান করুন।   আমীন।
মুফতী মাহমুদ হাসান
ইমাম ও খতীব
আল-হেরা জামে মসজিদ

জিগাতলা, ধানমন্ডি, ঢাকা

1 টি মন্তব্য:

Unknown বলেছেন...

এগুলোর লিংক যদি ভাইবেরাদারদের না দেন তাহলে কেমনে হবে?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন