পৃথিবীতে
সবচে’ শ্বাশ্বত সত্য ও সুনিশ্চিত বিষয় হল মৃত্যু। একবার যে জন্মেছে মৃত্যুর স্বাদ
তাকে আস্বাদন করতেই হবে। বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী, মুমিন-কাফির, আস্তিক-নাস্তিক সকলেই
এবিষয়ে একমত। অবিশ্বাসীরা আল্লাহর একত্ববাদকে অস্বীকার করেছে, আল্লাহর
প্রেরিত নবী-রাসুলদের অবাধ্য হয়েছে, আসমানি
কিতাবকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। কিন্তু মৃত্যু যে সকলের জন্য অবধারিত তা অস্বীকার করতে পারেনি।
তাই তো আল্লাহ তা’লা কুরআনে কারিমে ঘোষণা দিয়েছেন-
كُلُّ
نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ وَإِنَّمَا تُوَفَّوْنَ أُجُورَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ
অনুবাদ-
“প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ ভোগ করবে”। (সূরা....)
বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী
প্রতিটি মানুষ যেমন বিশ্বাস করে যে, মৃত্যুর স্বাদ একদিন ভোগ করতেই হবে। তেমনিভাবে
এটাও বিশ্বাস করে যে, এই মৃত্যু কখন, কোথায়, কীভাবে আসবে তা কেউ জানে না। মৃত্যু
হল সময়-কাল-স্থানের ঊর্ধ্বে। যে কোনো সময়,
যে কোন মুহূর্তে, যে কোন স্থানে মৃত্যুর দূত
হাযির হতে পারে। শিশু, যুবক অথবা বৃদ্ধ
যখনই মৃত্যুর সময় হবে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। একটুও নড়চড় হবে না। সবার তরে এ
বাস্তবতা চিরসত্য। কোরআনে কারিমের সূরা আরাফের ৩৪ নম্বর আয়াতে এসম্পর্কে এরশাদ হয়েছে-
وَلِكُلِّ
أُمَّةٍ أَجَلٌ فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ
অনুবাদ-
“আর প্রত্যেক জাতিরই রয়েছে নির্দিষ্ট মেয়াদ। যখন তাদের সেই নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হবে
অর্থাত মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসবে তখন তারা এক মুহূর্ত
বিলম্বও করতে পারবে না, আবার এক মুহূর্ত আগেও যেতে পারবে না”। (সূরা আরাফ-৩৪)
মৃত্যুর
চিন্তা ও স্মরণ থেকে আমাদের উদাসীনতার মূল
কারণ হলো দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা ও পার্থিব জীবনের আসক্তি। জীবনোপকরণ হিসেবে পার্থিব ভোগসামগ্রীর চাহিদা
থাকা শরিয়তে নিষিদ্ধ নয়, বরং অনুমোদিত ও
কাম্য। কেননা রাসূল সা. এক হাদিসে এরশাদ করেছেন- “হালাল রিজিকের অন্বেষণ করা
ইসলামের দ্বিতীয় পর্যায়ের একটি ফরজ ইবাদত”। কিন্তু দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হওয়া ও পার্থিব
ধন-সম্পদের মোহগ্রস্ত হওয়া শরীয়তে নিষিদ্ধ
ও অপছন্দনীয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীসে বলেছেন- “দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসাই সকল পাপের মূল”। দুনিয়ার
এই আসক্তিই মানুষকে
প্রবৃত্তির পূজারী বানায়। কামনা-বাসনার অনুগামী করে। পরিশেষে কুপ্রবৃত্তির
এই চাহিদা ও ভোগবাদী মানসিকতা মানুষকে বাধ্য
করে মৃত্যু ভাবনাহীনভাবে দিন-রাত অতিবাহিত
করতে। একপর্যায়ে
হালাল-হারাম ও বৈধ-অবৈধ কোন কিছুর
তোয়াক্কাই করেনা। শুধুমাত্র অর্থবিত্তের নেশায় আচ্ছন্ন
হয়ে পড়ে। এ সম্পর্কেই কোরআনে কারিমে আল্লাহ
তা’লা এরশাদ করেছেন-
زُيِّنَ
لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ وَالْقَنَاطِيرِ الْمُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ذَلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَاللَّهُ عِنْدَهُ حُسْنُ الْمَآبِ
অনুবাদ-
“আর মানুষের সামনে সুশোভিত করে দেয়া হয়েছে পার্থিব ভোগ সামগ্রীর ভালবাসা। নারী,
সন্তানাদি, রাশিরাশি সোনা-রূপা, মূল্যবান উষ্ট্রী, এবং সুদৃশ্য গবাদি পশু ও
সুজলা-সুফলা শস্যক্ষেত। আর এগুলো তো শুধুমাত্র পার্থিব জীবনের উপকরণ মাত্র। অথচ
আল্লাহর নিকট রয়েছে সর্বোত্তম উপকরণসমূহ”। (সূরা আল-ইমরান-১৪)
দুনিয়া
ও পার্থিব জীবনের এই আসক্তি থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হল- মৃত্যুচিন্তা ও পরকাল ভাবনা। এই জন্য কোরআনে কারিমে ও হাদিস শরীফে বার বার মৃত্যুর কথা আলোচনা
করা হয়েছে। মৃত্যুচিন্তাকেঅন্তরে জাগ্রত করতে
নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অধিক হারে মৃত্যুকে
স্মরণ করতে আদেশ করা হয়েছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- “পার্থিব সকল বস্তুর
স্বাদ বিনষ্টকারী মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ কর”।
হযরত আনাস (রাঃ) এর
সূত্রে অন্য এক হাদীসে রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেছেন- “তোমরা মৃত্যুর কথা বেশি স্মরণ
কর। কেননা মৃত্যুর স্মরণ মানুষকে পাপ থেকে দূরে রাখে এবং দুনিয়ার প্রতি আকর্ষণ কমিয়ে
দেয়। ধন-সম্পদের মধ্যে যদি মৃত্যুকে স্মরণ কর তবে তোমার অন্তর সম্পদের লিপ্সা থেকে
মুক্ত থাকবে। যদি অভাব-অনটনের সময় মৃত্যুকে স্মরণ কর তবে দুঃখবোধ থেকে মুক্ত থাকেত
পারবে”। (ইবনে আবিদ
দুনিয়া)
অপর এক হাদীসে
এসেছে- “রাসূল (সাঃ) কে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, হাশরের ময়দানে শহীদদের সাথে কি আর কাউকে উঠানো হবে?
তিনি উত্তরে বলেছিলেন, হ্যাঁ! যে
ব্যক্তি দিন রাতের মধ্যে অন্ততঃ ২০ বার মৃত্যুর কথা স্মরণ করে সে হাশরের ময়দানে
শহীদদের সাথে পুনরুত্থিত হবে। (তাবরানী)
মুসান্নাফে ইবনে আবী
শায়বার এক হাদীসে এসেছে- “রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেছেন, দুনিয়ার প্রতি বিতৃষ্ণা এবং আখেরাতের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টির জন্য মৃত্যুর
প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসই যথেষ্ট”। (ইবনে আবি
শাইবা, আহমদ)
আল্লামা ইবনে
তাইমিয়া রহ. বর্ণনা করেন- “দু’টি বিষয় আমাকে
দুনিয়ার যাবতীয় ভোগ বিলাসের স্পৃহা থেকে বিরত রেখেছে। এক, মৃত্যুচিন্তা। দুই, হাশরের ময়দানে আল্লাহর
সামনে দাঁড়ানোর ভীতি। (ইবনে আবিদ দুনিয়া)
বিখ্যাত সাহাবী হযরত
আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন- “একবার এক ব্যক্তি রাসূল (সাঃ) এর খেদমতে উপস্থিত
হয়ে বলল, মৃত্যুর কথা শুনতে আমার মোটেও ভাল লাগেনা। তখন রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি ধন-সম্পদ আছে? লোকটি
বলল, হা, তার কাছে বেশ ধন-সম্পদ আছে। তখন আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাকে বললেন, ধন-সম্পদ পরকালের জন্য পাঠিয়ে দাও। দেখবে তোমার মনও আখেরাতের দিকে ধাবিত হতে থাকবে। কেননা, মানুষের মন তার ধন সম্পদের প্রতি আকৃষ্ট থাকবে এটাই তো
স্বাভাবিক”। (আবু নাঈম)
বেশি
বেশি মৃত্যুকে স্মরণ করার বিভিন্ন উপায় মুসলিম মণীষীগণ উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে হাকিমুল
উম্মত হযরত থানভী রহ. বলেন- “মৃত্যু স্মরণ সর্বদা অন্তরে জাগ্রত রাখার জন্য সহজ
উপায় হল, প্রতি রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে একবার নিজের সারাদিনের কর্মকাণ্ডের
হিসেব-নিকেশ করা। এবং একবার অন্তত নিজেকে অন্ধকার কবরের বাসিন্দা মনে করে চোখ দুটি
বন্ধ করে মৃত্যুর কথা স্মরণ করা”। এব্যপারে তিনি খলিফাতুল
মুসলিমীন হযরত উমর রা. এর উক্তি উল্লেখ করেছেন। উমর রা. এরশাদ করেন-
حاسبوا قبل أن تحاسبوا و زنوا قبل أن توزنوا
অনুবাদ-
“তোমাদের হিসাব নেয়ার পূর্বে নিজেরাই নিজেদের হিসেব সাজিয়ে নাও। এবং তোমাদের আমল
যাচাই-বাচাইয়ের পূর্বে তোমরাই তা পরখ করে দেখে নাও”।
আখেরাতের
জীবনের তুলনায় দুনিয়ার জীবন অতল সমুদ্রের এক ফোঁটা পানির মতো। সুতরাং দুনিয়ার
জীবনের বস্তুসামগ্রী যোগানোর চেয়ে আখেরাতের পাথেয় সঞ্চয়ের প্রয়োজন অনেক বেশি। এই
জন্য ইমাম গাযালি (রহ.) বলেন, তুমি
দুনিয়াতে যতদিন অবস্থান করবে, সে হিসেবে এখানকার জন্য
উপকরণ জোগাও। আর আখেরাতে
তোমাকে যতকাল স্থায়ী হতে হবে, সে
হিসেবে সেখানকার জন্য সঞ্চয় গ্রহণ কর”।
ইবনে মাজার এক হাদীসে এসেছে- “হযরত ওমর (রাঃ) রাসূল
(সাঃ) কে প্রশ্ন করেছিলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ!
সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান ব্যক্তি কে? তিনি
জবাব দিয়েছিলেন, যে ব্যক্তি মৃত্যুর কথা বেশি স্মরণ করে এবং
মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের পাথেয় সংগ্রহে ব্যস্ত থাকে।(ইবনে
মাজা)
তিরমিজির অপর এক হাদিসে শাদ্দাদ ইবনে আওস (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেছেন,
“যে ব্যক্তি স্বীয় প্রবৃত্তির উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে
সমর্থ হয়েছে এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য আমল করেছে সেই সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান লোক। অপরদিকে যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে অনেক কিছু আশা করে কিন্তু প্রবৃত্তিকে
মোটেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না তার সকল প্রয়াসই পশু শ্রম হবে। (ইবনে
মাযাহ, তিরমিযী)
আমাদের প্রকৃত
জীবন আখেরাত হলেও আমরা দুনিয়ার জন্যই বেশি সময় ব্যয় করি। প্রতিদিন জীবন-জীবিকার
জন্য যে সময়টুকু দিই এর সিকিভাগও আমরা দিই না পরকালের জন্য। অথচ উচিত ছিল পরকালের
জন্য বেশি সময় বরাদ্দ রাখা। যেহেতু দুনিয়াতে থাকতে হবে অল্প কিছু দিন তাই এর
প্রস্তুতিও সে অনুযায়ীই হওয়া উচিত। যেটুকু না হলেই নয় সেটুকুই দুনিয়ার জন্য বরাদ্দ
রাখা। আমরা যতই দুনিয়া কামাই করি এর কিছুই আমাদের সঙ্গে যাবে না। আমাদের এই
অল্পদিনের কর্মকাণ্ডই পরকালে সাথী হবে।
তাই আসুন আমরা
পার্থিব জীবনে আখেরাতকে প্রাধান্য দিই। মৃত্যুর কথা চিন্তা করি। পরকালের
জবাবদিহিতা এবং আল্লাহভীতিকে অন্তরে ঠাই দেই। সকল অন্যায়-অপকর্ম ছেড়ে আল্লাহ এবং
তার রাসূলকে অনুসরণ ও অনুকরণ করে জিন্দেগী অতিবাহিত করি ও পরকালের পাথেয় সঞ্চয়
করি। আল্লাহ আমাদের সে তাওফীক ও শক্তি দান করুন। আমীন ॥
gydwZ gvngy`
nvmvb
Bgvg I LZxe
Avj-†niv Rv‡g gmwR`
wRMvZjv,
avbgwÛ, XvKv
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন