জ্ঞান ও প্রতিভা আল্লাহ তা’লার এক বিশেষ দান ও অনুগ্রহ। যারা জ্ঞানী তারা সমাজে যেমন মর্যাদাবান তেমনি আল্লাহর কাছেও প্রিয়। জ্ঞানী ও মূর্খ লোকদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণ, নৈতিকতা-মানবিকতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিশাল পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যুগে যুগে যত ধর্ম, সমাজ ও সভ্যতা বিগত হয়েছে সকলের কাছেই জ্ঞানী ব্যক্তির মর্যাদা ছিল অতুলনীয়। এই জন্যই বলা হয়ে থাকে- ‘মূর্খ বন্ধুর চেয়ে জ্ঞানী শত্রু উত্তম’।
ইসলাম ধর্মে জ্ঞানার্জনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং জ্ঞানী ব্যক্তিকে সর্বাধিক মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে। মানব সভ্যতার মুক্তির জন্য আমাদের রাসূল সা. কে যখন রিসালাতের দায়িত্ব দেয়া হয় তখন সর্বপ্রথম যে বাণী নাযিল করা হয়েছিল তা হল- ইকরা! অর্থাত পড়, জ্ঞান অর্জন কর। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তা’লা জ্ঞানী ব্যক্তির মর্যাদা সম্পর্কে অনেকগুলো আয়াত অবতীর্ণ করেন।
সূরা মুজাদালার ১১ নং আয়াতে আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন-
[المجادلة: ১১]، {يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ} قال الله تعالى :
‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার ও যারা জ্ঞানী আল্লাহ তা’লা তাদের মর্যাদাকে সুউচ্চ করে দিবেন।’
সূরা যুমারের ৭৫ নং আয়াতে মহান আল্লাহ তা’লা উল্লেখ করেন-
قال الله تعالى : (قل هل يستوى الذين يعلمون و الذين لايعلمون) الزمر/৭৫
‘আপনি বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি মর্যাদায় সমান হতে পারে’।
সূরা ফাতেরের ২৮ নং আয়াতে মহান আল্লাহ তা’লা উল্লেখ করেন-
قال الله تعالى : ( إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ غَفُورٌ ) فاطر/২৮
‘নিশ্চয় আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই কেবল আল্লাহ তা’লাকে ভয় করে।’
সূরা নহলের ৪১ নং আয়াতে আল্লাহ তা’লা মূর্খ ব্যক্তিদের জ্ঞানীদের শরনাপন্ন হতে নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন-
قال الله تعالى : فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لا تَعْلَمُونَ [الانبياء:৭].
‘যে বিষয়ে তোমরা যারা জান না, সেক্ষেত্রে জ্ঞানী ব্যক্তিদের শরনাপন্ন হও।’
সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী হযরত মুহাম্মদ সা. জ্ঞানী ব্যক্তিদের মর্যাদার ব্যপারে বহু হাদীস উল্লেখ করেছেন। এক হাদীসে তিনি এরশাদ করেন- ‘জ্ঞানের মর্যাদা আমার নিকট ইবাদতের চেয়েও বেশি।’ (তাবরানী, হাকেম, ছহীহুল জামে- হাদীস নং-৪৩১৪)
অন্য এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল সা. বলেন- ‘একজন ইবাদাতকারীর উপর জ্ঞানী ব্যক্তির মর্যাদা হল সমস্ত তারকারাজির উপর চাঁদের মর্যাদার সমতুল্য। আর জ্ঞানীরা হলেন নবীদের উত্তরাধিকারী। নবীগণ উত্তরাধিকার হিসেবে অর্থ-সম্পদ রেখে যান না, বরং তারা জ্ঞানকে রেখে যান।’ (আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজা)
মানুষ মৃত্যুবরণ করার সঙ্গে সঙ্গে তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তির আমল জারি থাকে। একজন জ্ঞানী জীবিত অবস্থায় জ্ঞান বিতরণ করার কারণে অনেকে উপকৃত হয়ে থাকেন, সেজন্যে মৃত্যুবরণ করার পরও তাদের মাধ্যমে তিনি সওয়াব পেতে থাকেন। এ বিষয়ে আল্লাহর রাসূল সা. এরশাদ করেন- ‘মানুষ যখন মারা যায় তখন তার সকল আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি উতস থেকে তা অব্যাহত থাকে: সদকায়ে জারিয়া, উপকারী জ্ঞান ও নেক সন্তান।’ (সহীহ মুসলিম-৪৩১০)
জ্ঞানী ব্যক্তির মর্যাদা সম্পর্কে অন্য এক হাদীসে এসেছে- ‘একবার আল্লাহর রাসূল সা. মসজিদে এসে দেখলেন, দুটি দল মসজিদে বসে আছে। এক দল আল্লাহ তা’লাকে স্মরণ করছে আরেক দল জ্ঞান চর্চা করছে। রাসূল সা. এরশাদ করলেন, উভয় দলই উত্তম। তবে আমার নিকট জ্ঞান চর্চাকারী দলটিই অধিক প্রিয়। কেননা এই পৃথিবীতে আমি একজন শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি।’ (ইবনে মাজাহ-১০১)
এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য সব কিছুই আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে। এমনকি সমুদ্রের মাছ পর্যন্ত [সহীহ মুসনাদ আবী ইআলা: ২/২৬০]
ইসলামের দৃষ্টিতে জ্ঞান ও জ্ঞানীর মর্যাদা কত বেশি তার একটি উদাহরণ হল- কোরআন মাজিদে বর্ণিত হজরত আদম (আ.) কে সৃষ্টির সময়ের ফেরেশতাদের আপত্তির ঘটনা। আল্লাহ পাক পৃথিবীতে আপন প্রতিনিধি খলিফা হিসেবে মানুষকে প্রেরণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে ফেরেশতারা আপত্তির সুরে বলেছিলেন, আপনার গুণগান এবং পবিত্রতা বর্ণনার জন্য তো আমরাই যথেষ্ট। এরপরও পৃথিবীতে হানাহানি করবে, রক্তপাত ঘটাবে এমন আদমকে কেন সৃষ্টি করবেন? তখন আল্লাহ তা’লা আদমকে খলিফার যোগ্যতা হিসেবে সব ধরনের জ্ঞান শিক্ষা দিলেন আর ফেরেশতাদের সামনে উপস্থিত করে বললেন যে, তোমরা এগুলোর নাম-পরিচয় বল দেখি। ফেরেশতারা অপারগতা স্বীকার করলেন আর আদম (আ.) সবকিছুর নাম-পরিচয় বলে দিলেন। যারফলে আল্লাহ তা’লা ফেরেশতাদের হুকুম দিলেন আদমকে সেজদা করার জন্য। কোরআন মাজিদে বর্ণিত ঘটনার এই সার-সংক্ষেপ প্রমাণ করে, আদমের শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড হচ্ছে জ্ঞান। জ্ঞানী আদম (আ.) এর সামনে ফেরেশতারাও সেজদায় অবনত হয়েছিল।
বসরার প্রখ্যাত বিদ্বান খলীল বিন আহমদকে একবার জিজ্ঞাসা করা হল, জ্ঞানীর মর্যাদা বেশী, নাকি রাজা-বাদশাহর? তিনি জবাব দিলেন, জ্ঞানী ব্যক্তির মর্যাদা বেশি । কেননা, জ্ঞান অর্থাত- শিক্ষা-দীক্ষা ছাড়া কোন রাজ্য চলতে পারে না । তখন প্রশ্নকারী পুনরায় জিজ্ঞাসা করল, জ্ঞানীরা তো অহরহ বাদশাহর দরবারে গিয়ে হাজির হন, কিন্তু কোন বাদশাহ তো সাধারণত জ্ঞানীর দরবারে যায় না। খলীল বিন আহমদ তখন জবাব দিলেন, কারণ, জ্ঞানীরা তো বাদশাহর মর্যাদা সম্পর্কে জানে। এই জন্য তারা বাদশাহর দরবারে যান। কিন্তু বাদশাহগণ জ্ঞানী ব্যক্তির মর্যাদা সম্পর্কে ওয়াকেফহাল নয়। এই জন্য তারা কখনো জ্ঞানীদের দরবারে যায় না।
মুসলিম মনীষী ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রাঃ) ছিলেন অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী। হযরত আলী (রাঃ) কত জ্ঞানী-গুণী ছিলেন হাদীস শরীফের একটি উক্তি দেখলেই সহজে বোঝা যায়। রাসুলে কারীম (সাঃ) পবিত্র হাদীস শরীফে ঘোষণা করেছেন, “আমি জ্ঞানের শহর হলে হযরত আলী সেই জ্ঞানের দরজা ''।আলী রা. জ্ঞান ও জ্ঞানী ব্যক্তির মর্যাদা সম্পর্কে বর্ণনা করেন- ‘আমাদের জন্য অর্থাত- মুসলমানদের জন্য জ্ঞানই যথেষ্ট। আর মূর্খদের জন্য হল সম্পদ। কেননা, সম্পদ খুব দ্রুতই নি:শেষ হয়ে যায়, কিন্তু জ্ঞান কখনো নি:শেষ হয়না, বরং সদা-সর্বদা টিকে থাকে”।
আখেরাতে কামিয়াবি ও পৃথিবীতে উন্নতি লাভ করতে হলে জ্ঞানার্জনের বিকল্প নেই। বর্তমান আধুনিক এ পৃথিবীতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, যানবাহন, কল-কারখানাসহ প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে, তা জ্ঞানার্জনের ফলেই সম্ভব হয়েছে। জ্ঞানীরাই হচ্ছেন দেশ, জাতি ও সমাজের মূল্যবান সম্পদ। যে সমাজে জ্ঞানীদের সংখ্যা যত বেশি সে সমাজ তত উন্নত। জ্ঞানীদের নির্দেশিত পথে চললেই সঠিক পথের দিশা পাওয়া সম্ভব। এ জন্য জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান লোকদের কদর করতে হবে। তাদের দ্বারা উপকৃত হতে হবে। তবেই সমাজ ও দেশ হবে আলোকিত।
প্রচার: ২রা জানুয়ারী ২০১৬, শনিবার, সকাল ৬:৩০
প্রচার তরঙ্গ: এফএম-১০৬.০০
বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা।
প্রচার: ২রা জানুয়ারী ২০১৬, শনিবার, সকাল ৬:৩০
প্রচার তরঙ্গ: এফএম-১০৬.০০
বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন