আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন
সৃষ্টির সেরা জাতি হিসেবে। তাদেরকে এমন বহুবিধ বৈশিষ্ট্য দান করেছেন, যা অন্য কোনো সৃষ্টিজীবকে দেয়া হয়নি।
মানবজাতিকে দেয়া আল্লাহ তা’লার সবচেয় উত্তম বৈশিষ্ট হল- আকল তথা জ্ঞান-বুদ্ধি। এই
জ্ঞান-বুদ্ধির কারণেই মানুষ আজ পৃথিবীতে নিজেদেরেক অন্যন্য জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত
করেত পেরেছে। নিজেদেরকে করে তুলেছে সুরক্ষিত, সুশিক্ষিত ও সকল গুণে বৈশিষ্টমণ্ডিত।
মানুষকে আল্লাহ তা’লা এই জ্ঞান-বুদ্ধি দেয়ার মূল কারণ ছিল, যাতে বান্দা তারা
সৃষ্টিকর্তাকে চিনতে পারে এবং সৃষ্টিকর্তার মর্জি মোতাবেক নিজেদের জীবনকে
সুচারুরূপে পরিচালনা করতে পারে। এতদসত্তেও তাদের দিকনির্দেশনার জন্য যুগে যুগে
হেদায়েতের বার্তাসহ পাঠিয়েছেন, অসংখ্য নবী-রাসূল। কিন্তু একদল খোদাদ্রোহী লোক আল্লাহ তা’লার প্রেরিত এসকল নবী-রাসূলদেরকে
অস্বীকার করেছে এবং তাদের আনীত জীবন বিধানকে অবজ্ঞা করেছে। সাথে সাথে তারা
নবী-রাসূলদের কাছ থেকে তাদের নবুওয়াতের সত্যতার প্রমাণ দাবী করেছে। তাদের দাবীর
প্রেক্ষিতে, নবী-রাসূলদের নবুওত ও রেসালাতের সত্যতা প্রতিষ্ঠিত করা এবং মানুষের
নিকট তাদের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে আল্লাহ তাআলা নবীদেরেক দিয়েছেন বিভিন্ন
নিদর্শন। এ সকল নিদর্শনকেই ইসলামের পরিভাষায় মোজেযা বলা হয়। মু’জিযাকে
পবিত্র কুরআনে কারীমে আয়াত, বায়্যিনা, বুরহান, সুলতান ইত্যাদি শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। যেমন কুরআনে
কারীমের সূরা আনআমে আল্লাহ তা’লা ইরশাদ করেছেন-
وَ اَقْسَمُوْا بِاللهِ جَهْدَ اَیْمَانِهِمْ لَىِٕنْ جَآءَتْهُمْ اٰیَةٌ لَّیُؤْمِنُنَّ بِهَا قُلْ اِنَّمَا الْاٰیٰتُ عِنْدَ اللهِ وَ مَا یُشْعِرُكُمْ اَنَّهَاۤ اِذَا جَآءَتْ لَا یُؤْمِنُوْنَ.
“আর তারা আল্লাহর নামে কঠিন শপথ করে বলে, তাদের নিকট যদি কোনো নিদর্শন আসত তবে অবশ্যই তারা এতে ঈমান
আনত। আপনি বলুন, নিদর্শন তো
আল্লাহর এখতিয়ারভুক্ত। আর তাদের নিকট নিদর্শন আসলেও তারা যে ঈমান আনবে না, তা কীভাবে তোমাদের বোধগম্য করা যাবে”। -সূরা আনআম (৬) : ১০৯
অন্যত্র
ইরশাদ হয়েছে-
قَدْ جَآءَتْكُمْ بَیِّنَةٌ مِّنْ رَّبِّكُمْ هٰذِهٖ نَاقَةُ اللهِ لَكُمْ اٰیَةً.
তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ
থেকে স্পষ্ট নিদর্শন এসেছে। আল্লাহর এ উটনী তোমাদের জন্য একটি নিদর্শন।’
-সূরা আ‘রাফ : ৭৩
আয়াত, বায়্যিনা, বুরহান, সুলতান ইত্যাদি শব্দ নিদর্শনের অর্থ ছাড়া অন্য অর্থেও
কুরআনে কারীমে ব্যবহৃত হয়েছে। এজন্য উলামায়ে কেরাম নবী-রাসূলগণের এসব নিদর্শনকে বোঝাতে
মু‘জিযা শব্দে
অভিহিত করেছেন। আর মু‘জিযার অর্থ হল এমন নিদর্শন, যা অন্য কোনো মানুষকে এরূপ বিষয় প্রকাশ করতে অক্ষম
সাব্যস্ত করে।
পূর্ববর্তী যুগের নবী-রাসূলগণের শরীয়ত
যেহেতু ছিল সময় ও কালের সাথে সীমাবদ্ধম, তাই তাদের মু‘জিযাগুলোও ছিল তাদের সময়কালের সাথে
সম্পৃক্ত করে অস্থায়ী মু‘জিযা। যেমন হযরত মূসা আ.-এর লাঠি সাপে পরিণত
হওয়া, সালেহ আ.-এর উষ্ট্রী, হযরত ঈসা আ.-এর মৃতকে জীবিত করা, কুষ্ঠ রোগীকে হস্তস্পর্শে সুস্থ করে দেওয়া ইত্যাদি। কিন্তু
হযরত মুহাম্মদ সা. ছিলেন সর্বকালের এবং সকল জাতির সর্বজনীন নবী। তাই তাঁকে দেয়া
হয়েছে স্থায়ী মুজিযা, যার আবেদন ও অলৌকিকত্ব কেয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে।
হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামকে বিভিন্ন মুজিযা দেয়া হয়েছে।
তন্মমধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মু‘জিযা হল কুরআনে কারীম। এটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম-এর চিরন্তন মু‘জিযা, যা কিয়ামত পর্যন্ত আপন গুণে প্রদীপ্ত থাকবে। এর
অনুরূপ কোনো গ্রন্থ বা এর কোনো অংশবিশেষের অনুরূপ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কোনো রচনা পেশ
করা কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি এবং কিয়ামত পর্যন্ত সম্ভব হবে না। এ প্রসঙ্গে সূরা
হিজরে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
اِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَ اِنَّا لَهٗ لَحٰفِظُوْنَ.
‘আমিই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং অবশ্য আমিই
এর সংরক্ষক।’ -সূরা হিজর (১৫) : ৯
আর এ চিরন্তন মু‘জিযা সম্পর্কে একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَا مِنَ الأَنْبِيَاءِ نَبِيٌّ إِلَّا أُعْطِيَ مَا مِثْلهُ آمَنَ عَلَيْهِ البَشَرُ، وَإِنَّمَا كَانَ الَّذِي أُوتِيتُ وَحْيًا أَوْحَاهُ اللَّهُ إِلَيَّ، فَأَرْجُو أَنْ أَكُونَ أَكْثَرَهُمْ تَابِعًا يَوْمَالقِيَامَةِ.
‘নবীগণের মধ্যে প্রত্যেক নবীকে এমন
নিদর্শন প্রদান করা হয়েছে, যার প্রতি মানুষ
আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করেছে,আর আমাকে যে নিদর্শন প্রদান করা হয়েছে তা হল ওহী অর্থাত
কুরআনে কারীম, আল্লাহ তাআলা
আমার নিকট তা প্রেরণ করেছেন। আমি আশা করি যে, আমি হব তাদের মধ্যে সর্বাধিক অনুসারীর অধিকারী।’
-সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫২
কুরআনে কারীম ছাড়াও রাসূল সা. কে আল্লাহ
তা’লা আরো কিছু মুজিযা দান করেছিলেন। তন্মধ্যে অন্যতম হল- হাতের ঈশারায় চাঁদ
দ্বিখণ্ডিত হওয়া।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের সূরা ‘আল কামা’র আল্লাহ তা’লা ঘটনার ইঙ্গিত দিয়েছেন। এছাড়া বহু মোতাওয়াতের
রেওয়াতের দ্বারাও এর অকাট্য প্রমাণ সুপ্রতিষ্ঠিত। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে হযরত আলী
(রা.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.), হযরত জুবাইর ইবনে মোতয়েম (রা.), হযরত হোজাইফা ইবনুল ইয়ামান (রা.) এবং হযরত আনাস ইবনে মালেক
(রা.) সহ অনেকেই চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার মুজিযার কথা বর্ণনা করেছেন। হাদীস
গ্রন্থসমূহের মধ্যে বোখারী ও মুসলিম ছাড়াও বহু নির্ভরযোগ্য প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থে
এ আলোড়ন সৃষ্টিকারী মোজেযার বর্ণনা রয়েছে।
হিজরতের পূর্বে মক্কায় এক রাতে আবু জেহেল, অলীদ ইবনে মুগীরা, আছ ইবনে ওয়ায়েল প্রমুখ কোরাইশ কাফের নেতৃবর্গ সমবেত হয় এবং রাসূলুল্লাহ
(সা.)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে বলে যে, আপনি যদি সত্য নবী হয়ে থাকেন তাহলে আকাশের এই চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করে দেখান, যার
অর্ধেক আবু কোবাইস পর্বতে এবং অর্ধেক কাইকুআন পর্বতে পতিত হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.)
বললেন, আমি যদি তা করে দেই তাহলে তোমরা ঈমান আনবে
কি?
তারা বলল, হাঁ। বর্ণনাকারী বলেন, রাতটি ছিল পূর্ণিমার।
রাসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেন, তারা যা চায় তা যেন আল্লাহ তাকে দান করেন। অতঃপর চাঁদ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, অর্ধেক আবু কোবাইল পর্বতে পতিত হয় এবং অর্ধেক কাইকুআন
পর্বতে পতিত হয়। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে আবু সালমা, হে আবদুল আসাদ এবং হে আরকাম
ইবনে আরকাম, তোমরা সবাই সাক্ষী থাক।
রাসূলের আরেকটি ঐতিহাসিক মুজিযা হল, মেরাজ।
নবুওয়াতের দশম বর্ষে রজব মাসের ২৭ তারিখ নবী করিম সা:-এর ৫০ বছর বয়সে পবিত্র মেরাজ
সংঘটিত হয়। সে রাতে কিছু সময়ের মধ্যেই তিনি মক্কা মুকাররমা থেকে বায়তুল মাকদিস গমন
করেন এবং সেখান সকল নবী-রাসূলদের নিয়ে দু’রাকাত নামাজ আদায় করেন। অতপর সাত আসমান
পারি দিয়ে সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছেন এবং আল্লাহ তা’লার সাথে সরাসরি সাক্ষাত করেন।
এবং সেখানেই আল্লাহ তা’লা আমাদের জন্য দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ করেন। মেরাজের ঘটনা পবিত্র কুরআনুল কারিম এবং অসংখ্য
মাশহুর, মুতাওয়াতির
হাদিস দ্বারা প্রমাণিত; তা অস্বীকার করা কুফুরি। মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র
কুরআনের সূরা ঈসরায় এ প্রসঙ্গে ইরশাদ করেন-
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِنْ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا
‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতের বেলা ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে
হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার চার দিকে আমি
পর্যাপ্ত বরকত দান করেছিলাম যেন আমি তাঁকে আমার নিদর্শনাবলি (কুদরতিভাবে) দেখাতে
পারি’। (সূরা বনি ইসরাইল : ১)
এ সকল মুজিযা ছাড়াও রাসূল সা. কে আল্লাহ তা’লা আরও বহু মুজিযা দান করেছিলেন।
যেমন-
মসজিদে
নববীতে মিম্বর তৈরীর আগে রসূল (স.) খেজুর গাছের একটি কাণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে খোতবা
দিতেন। মিম্বর তৈরীর পর রসূল (স.) সেই খেজুর গাছের কাণ্ডটি ব্যবহার করা বন্ধ করে
দেন। এর ফলে সেই কাণ্ডটি কাঁদতে শুরু করলো। রসূল (স.) সেই কাণ্ডটি কাছে এসে তার
ওপর হাত রাখলেন। এতে
সেই কাণ্ডটির কান্না বন্ধ হয়ে গেল।
একবার
সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে জাওবা নামক জায়গায় অবস্থান করছিলেন। সেখানে পানির অভাব
ছিল। তখন তিনি পানিপূর্ণ একটি পাত্র আনালেন এবং সেই পাত্রে হাত ঢুকালেন। সাথে সাথে
তাঁর আঙ্গুল থেকে পানির ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হতে লাগলো। সেই পানি দ্বারা তিনি এবং
সাহাবায়ে কেরাম ওযু করেন।
হোদায়বিয়ার
সন্ধির সময়ে রসূল (স.) শুকনো কূয়ায় ওযুর অবশিষ্ট পানি ফেলে দিয়ে দোয়া করেন। ফলে সেই
কূয়া পানিতে পূর্ণ হয়ে যায়।
এধরণের
অসংখ্য মুজিযা আল্লাহ তা’লা রাসূল সা. কে দান করেছিলেন। মু‘জিযার সম্পর্কে জানার উদ্দেশ্য
হল, সেগুলোকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা এবং দ্বিধাহীন চিত্তে সেগুলোর প্রতি ঈমান আনা।
যাতে রাসূলের প্রতি আমাদের ঈমান আরো দৃঢ় হয় এবং বাস্তব জীবনে আমরা যেন
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের আরো বেশি গুরুত্ব দেই। আল্লাহ তা’লা আমাদের সকলকে রাসূল সা. এর মুজিযার
প্রতি পরিপূর্ণ ঈমান আনার তাওফিক দান করেন এবং রাসূলের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে সুন্দর
ব্যক্তি জীবন ও সমাজ জীবন গঠন করতে পারি। আমীন।
মুফতি মাহমুদ হাসান
ইমাম ও খতীব
আল-হেরা জামে মসজিদ
জিগাতলা, ধানমন্ডি, ঢাকা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন