“পাড়ি দিতে নদী, হাল ভাঙ্গে যদি, ছিন্ন পালের কাছি;
মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়ায়ে জানিবো- তুমি আছো, আমি আছি।” --
-কবি ফররুখ আহমদ
দ্বীনের প্রতি গভীর অনুরাগ, ইশকে মাওলার প্রতি সীমাহীন আকর্ষণে আবেগাপ্লুত হয়ে ‘তিনি’ প্রায়শই ফররুখের এই চরণ দুটি আবৃত্তি করতেন। তখন অশতীপর এই বৃদ্ধের চোখে-মুখেও ফুটে উঠত তারুণ্যের ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা ও মুহাব্বতে ইলাহীর ঐশী জ্যোতির্ময়তা। আমরা তখন তন্ময় হয়ে তাঁর মুখাবয়ব লক্ষ্য করতাম আর আবৃত্তি শুনতাম। সে সময় আমরা ছিলাম খুব ‘ছোট’ আর তিনি ছিলেন অনেক ‘বড়’। তাই ইশকে মাওলার প্রতি তাঁর এত বড় হৃদয়ের আবেগ-অনুভূতি আমাদের মত ছোট্ট হৃদয়ে উপলব্ধি করার কথা নয়। ফলে শুধু চর্ম চক্ষু দিয়ে তাঁকে দেখতাম আর আর কান দিয়ে তাঁর আবৃত্তিটুকুই শুনতাম। কিন্তু সে সময়ে মাওলার সান্নিধ্যের জন্য তাঁর হৃদয়ের আকুতি-মিনতি বোঝার সাধ্য কোথায় আমাদের......???
‘তিনি’ হলেন সদ্য প্রয়াত আল্লামা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ রহ.। ছাত্রদের মহলে তিনি ‘কাজী সাহেব’ নামে পরিচিত। শাইখুল ইসলাম হযরত হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ. এর একান্ত শিষ্য ছিলেন তিনি। দ্বীনের ব্যপারে ‘আশিদ্দা’ এবং ব্যক্তিগত ব্যপারে ‘রুহামা’ হওয়ার দীক্ষা তিনি গ্রহণ করেছিলেন মাদানী রহ. এর কাছ থেকেই। আর সারা জীবন তিনি এর উপরই অটল ছিলেন।
২০১০ সালের মালিবাগ জামিয়ার ফারেগীন ছাত্রদের একটা বিশেষ সৌভাগ্য ছিল। কারণ, এই বছরই কাজী সাহেব সর্বশেষ নিয়মিত দরস প্রদান করতে পেরেছিলেন। আল্লাহ তা’লা আমাকেও ঐ কাফেলায় শরীক রেখেছিলেন। ফলে হযরতের ব্যক্তিত্বের বড়ত্বের কিছুটা আন্দায করতে পেরেছিলাম।
বড়দের কাছে যাওয়া এবং তাঁদের সান্যিধ্যে সময় কাটানো নি:সন্দেহে বহুত খোশ নসীব এবং পরম সৌভাগ্যের বিষয়। আর তাঁদের কিছু ছিফাত ও আদর্শ গ্রহণ করাটা তো রীতিমত অতিরিক্ত পাওনা। এটা তাদের পক্ষেই সম্ভব যাদের উপর আল্লাহর বিশেষ রহমত আছে। যাদেরকে আল্লাহ তা’আলা দেড়হাতী কপাল দিয়েছেন। আমার মত আধহাত কপালী মানুষের পক্ষে এটা আকাশ কুসুম কল্পনা বৈ কিছু নয়। তদুপরি দরসের বদৌলতে যেহেতু হযরতকে খুব কাছ থেকে দেখেছি নিয়মিত কিছু আলোচনা-পর্যালোচনা শুনেছি, সেই আন্দায থেকেই হযরতকে নিয়ে কিছু লিখার দু:সাহস করেছি।
আমি আমার ক্ষুদ্র পরিসরে হযরতকে যতটুকু দেখেছি এবং হযরত সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি তা থেকে হযরতের এমন দুটি অবিনব গুণের পরিচয় পেয়েছি যা তাঁর সমসাময়িক অন্যদের মাঝে ছিল বিরল।
১. যুহদ ফিদ্দুনিয়া তথা সম্পূর্ণরূপে দুনিয়া বিমুখতা।
২. ইসতিকামাত ফিদ্দীন তথা দ্বীনের বিষয়ে স্পাত কঠিন দৃঢ়তা ও পাহাড়সম অনঢ়তা।
এক. .................. পৃথিবীতে তুমি এমনভাবে জীবন যাপন কর যেন তুমি একজন মুসাফির কিম্বা কোন পথিক।
হযরতের জীবন যাপন মূলত এই হাদীসটিরই বাস্তবরূপ ছিল। তিনি এতটা দুনিায়া বিমুখ ছিলেন যে, মৃত্যুর সময় তাঁর ভিটে-মাটি বলেও কিছু ছিল না। অথচ মালিবাগ মাদ্রসার মত স্বনামধন্য একটা জামিয়ার দীর্ঘদিন মুহতামিম ছিলেন। তাঁর সমসাময়িক সমপর্যায়ের অনেক উলামায়ে কেরামই তাঁদের প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ যোগার করেছিলেন। ইচ্ছা করলে তিনিও নিজের জন্য নয়; সন্তানদের জন্য বৈধ পন্থায় কিছু রেখে যেতে পারতেন। কিন্তু কিছু করেন নি, নবীজীর এই হাদীসটির প্রতি লক্ষ্য রেখে- “আমি মিসকীন হয়ে জন্মেছি। মিসকীন হয়ে জীবন যাপন করছি। এবং মিসকীনদের সাথেই আমার হাশর-নাসর হবে।”
(চলমান...)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন