সৃষ্টিলগ্ন থেকেই মানুষ সুন্দরের পুজারী। সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধতা মানবমনের চিরায়ত ধর্ম। সেই মুগ্ধতা যখন অনুভব ও অনুভূতিকে ছাপিয়ে ভাষায় রূপায়িত হয় তখন তা হয় প্রশংসা। তাই প্রশংসা মানবমনের এক অনিবার্য আবেদন। পৃথিবীর শুরু থেকে সকল যুগে, সকল সমাজেই সত্য ও সুন্দরের বাস্তবসম্মত প্রশংসা নন্দিত ও পছন্দনীয়। কিন্তু প্রশংসা যখন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায় তখন তা আর প্রশংসনীয় থাকে না, বরং নিন্দনীয় ও ঘৃণিত হয়ে যায়। প্রশংসার ক্ষেত্রে এই বাড়াবাড়িকেই তোষামদ, খোশামদ ইত্যাদি শব্দে ব্যক্ত করা হয়।
ইসলাম ধর্মে বাস্তবসম্মত প্রশংসা অনুমোদিত হলেও, তোষামোদ বরাবরই নিন্দিত ও ঘৃণিত। কেননা তা তোষামোদকারী ও তোষামোদকৃত উভয় ব্যক্তির জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই প্রশংসার ক্ষেত্রে তোষামোদকে পরিহার করে, মাত্রাজ্ঞানের পরিচয় দেয়া ও মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা আবশ্যক।
কুরআনে কারীমে অবাস্তব প্রশংসা বা তোষামোদকে ইহুদী-খৃষ্টানদের বিশেষ বৈশিষ্ট হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। এ ব্যপারে সূরা তাওবায় আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন-
وَقَالَتِ الْيَهُودُ عُزَيْرٌ ابْنُ اللَّهِ وَقَالَتِ النَّصَارَى الْمَسِيحُ ابْنُ اللَّهِ ذَلِكَ قَوْلُهُمْ بِأَفْوَاهِهِمْ (سورة التوبة-৩০)
অর্থাৎ- ইহুদীরা বলে, আমাদের রাসূল উযাইর হলেন আল্লাহ তা’লার পুত্র। আর খৃষ্টানরা বলে, আমাদের রাসূল ঈসা মসীহ হলেন আল্লাহ তা’লার পুত্র। এগুলো মূলত তাদের মুখের অত্যুক্তি। (সূরা তাওবা-৩০) এই আয়াতের সমর্থনে সহীহ বুখারীর এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল সা.ও এই ধরনে প্রশংসা বা তোষামোদকে ইহুদী-খৃষ্টানদের স্বভাব আখ্যা দিয়ে ঘোষণা করেন- ইহুদী খৃষ্টানরা যেভাবে তাদের রাসূলদের অবাস্তব প্রশংসা করেছে তোমরা আমার ক্ষেত্রে এমন বাড়াবাড়ি বা তোষামোদি করো না।
কুরআনে কারীম ছাড়া বহু হাদীসেও আল্লাহর রাসূল সা. এই ধরনের অবাস্তব প্রশংসা বা তোষামোদকে কঠোর ভাষায় নিন্দা জানিয়েছেন। সহীহ মুসলিমের এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল সা. বর্ণনা করেন- ‘যখন তোমরা তোষামোদকারীদের সম্মুখীন হবে তখন তাদের চেহারায় মাটি নিক্ষেপ করো। (সহীহ মুসলিম-) উক্ত হাদিসটি তোষামোদকারীদের জন্য একটি সতর্কবার্তা। কারণ রহমত ও দয়ার ক্ষেত্রে যিনি অনুপম তিনিই এই সকল তোষামোদকারীদের চেহারায় মাটি নিক্ষেপ করতে বলেছেন।
অতিরিক্ত প্রশংসা বা তোষামোদ করা মূলত লজ্জাহীনতা ও অযোগ্যতার পরিচায়কও বটে। সাধারণত অযোগ্য এবং অকর্মণ্য ব্যক্তিরাই কিছু পার্থিব স্বার্থ হাসিলের জন্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের তোষামোদ করে। মন্দ দিকগুলো এড়িয়ে, শুধু অতিরঞ্জিত প্রশংসা করে তাদের নৈকট্য হাসিলের ঘৃণ্য প্রয়াসে লিপ্ত হয়। এদের ব্যপারে এক হাদিসে আল্লাহর রাসূল সা. বর্ণনা করেন- ‘দুর্বল ঈমানের পরিচয় হল, পার্থিব ধন-সম্পদের লোভে অন্যের অবাস্তব প্রশংসা করা বা তোষামোদ করা।’ এতে তোষামোদকৃত ব্যক্তি তুষ্ট হলেও পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
তোষামোদের কুফল বা ক্ষতির দিকগুলো আলোচনা করতে গিয়ে হযরত ইমাম গায্যালী রহ. তাঁর এক গ্রন্থে উল্লেখ করেন- অবাস্তব প্রশংসা বা তোষামোদ পাঁচটি ক্ষতি বয়ে আনে। তন্মধ্যে তোষামোদকারী ব্যক্তি তিনটি ক্ষতির সম্মুখীন হয় আর তোষামোদকৃত ব্যক্তি সম্মুখীন হয় দুটি ক্ষতির। তোষামোদকারী ব্যক্তি যে তিনটি ক্ষতির সম্মুখীন হয় তা হল-
এক. তোষামোদ করার মাধ্যমে তোষামোদকারী ব্যক্তি মূলত মিথ্যা ও প্রবঞ্চনার আশ্রয় নিয়ে থাকে। আর ইসলাম ধর্মে মিথ্যা বলা কবিরা গুনাহ বা মহাপাপ। এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল সা. এরশাদ করেন- ‘আমার উম্মত কখনো দুটি গোনাহ করতে পারে না। এক- মিথ্যা বলা। দুই- ধোঁকা দেয়া।’ সুতরাং তোষামোদকারী ব্যক্তি তোষামোদের মাধ্যমে কবিরা গোনাহের মত ভয়াবহ পাপে লিপ্ত হচ্ছে।
দুই. তোষামোদকারী ব্যক্তি তোষামোদের মাধ্যমে দ্বিতীয় যে ক্ষতির সম্মুখীন হয় তা হল- মুনাফেকি বা কপটতার শিকার হওয়া। অন্তরে একটা রেখে মুখে ভিন্ন কিছু প্রকাশ করাকে বলা হয় মুনাফেকি বা কপটতা। তোষামোদকারী ব্যক্তি বাস্তবতাকে অন্তরে গোপন রেখে মুখে ভিন্নটা প্রকাশ করে। জেনে-শুনে কপটতার আশ্রয় নেয়। সমাজ ও রাষ্ট্রকে বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। পরকালে সবচেয়ে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হবে এসকল মুনাফিকরা। কুরআনে কারীমে সূরা নিসায় আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন-
{ إِنَّ المنافقين فِي الدرك الأسفل مِنَ النار } [ النساء : ১৪৫ ]
অর্থাৎ- নিশ্চয় মুনাফিকরা জাহান্নামের সবচে’ নিম্নস্তরে থাকবে। (সূরা নিসা-১৪৫)
তিন. তোষামোদকারী ব্যক্তি তোষামোদের মাধ্যমে তৃতীয় যে ক্ষতির সম্মুখীন হয় তা হল- অন্যকে গোনাহে লিপ্ত করার ক্ষতি। কারণ, তোষামোদকৃত ব্যক্তি তোষামোদ শুনে নিজেকে বড় ও যোগ্য মনে করে। অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে থাকে। রিয়া বা লৌকিকতার শিকার হয়ে পড়ে। আর এগুলোর দায় বা গুনাহ মূলত তোষামোদকারী ব্যক্তির উপর বর্তায়।
অনুরূপভাবে তোষামোদকৃত ব্যক্তিও দুটি ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকে।
এক. তোষামোদকৃত ব্যক্তি অতিরিক্ত প্রশংসা শুনে আত্মম্ভরিতার শিকার হয়ে যায়। ফলে অন্তরে জন্ম নেয় অহংকার ও অহমিকার সর্বনাশা ব্যধি। যা তার সকল সদগুণকে ধ্বংশ করে দেয়। আর অহংকারী ও দাম্ভিককে আল্লাহ তা’লাও অপছন্দ করেন। কুরআনে কারীমে সূরা লুকমানে আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন-
إِنَّ الله لاَ يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ [ لقمان : ১৮ ]
অর্থাৎ নিশ্চয় আল্লাহ তা’লা অহংকারী ও দাম্ভিক ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না। (সূরা লুকমান-১৮)
দুই. তোষামোদকৃত ব্যক্তি দ্বিতীয় যে ক্ষতির সম্মুখীন হয় তা হল- মিথ্যা ও অতিরিক্ত প্রশংসা শুনে নিজের সম্পর্কে অনুরূপ ধারণা পোষণ করতে থাকে। অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে যোগ্য ভাবতে থাকে। পাশাপাশি মানুষের নিকট থেকে মিথ্যা প্রশংসাবাণী ও তোষামোদ শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। এ ধরনের ব্যক্তিদের কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে সূরা আল-ইমরানে আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন-
{ لاَ تَحْسَبَنَّ الذين يَفْرَحُونَ بِمَآ أَتَوْاْ وَّيُحِبُّونَ أَن يُحْمَدُواْ بِمَا لَمْ يَفْعَلُواْ فَلاَ تَحْسَبَنَّهُمْ بِمَفَازَةٍ مِّنَ العذاب وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ }
অর্থাৎ- যারা নিজেদের কৃতকর্মের ব্যপারে সন্তুষ্ট থাকে এবং কাজ ছাড়াই প্রশংসা শুনার জন্য উদগ্রীব থাকে তুমি মনে করো না যে, তারা আমার শাস্তি থেকে অব্যহতি লাভ করবে। (সূরা আল-ইমরান-১৮৮)
তোষামোদ মূলত মানুষের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাকে বিনষ্ট করে দেয়। কারণ, মানুষ যখন যোগ্যতার প্রয়োগ ছাড়াই প্রশংসা ও স্তুতি শুনতে পায় তখন মেধা ও শ্রম ব্যয় করতে আগ্রহী হয় না। ফলে আত্মতুষ্টিতে ভুগতে থাকে। আর আত্মতৃপ্তি ও আত্মতুষ্টি মানুষের শুধু উন্নতি ও অগ্রগতিকেই ব্যহত করে তা নয়, বরং ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের অবনতিকেও ত্বরান্বিত করে। কেননা গতিশীলতা হল সৃষ্টির স্বাভাবিক ধর্ম। তাকে ঊর্ধ্বমুখী না রাখলে অধঃগামী হবেই। অন্যদিকে তোষামোদ আর খোশামোদের আধিক্যের কারণে জাতীয় জীবনে আত্মসম্মান ও আত্ম পরিচয় বোধের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এরই ফলে পরষ্পর হানাহানি, কাাঁদা ছোঁড়াছুড়ি, দ্বন্দ, অবিশ্বাস বা মিথ্যাচারের সয়লাবে ভেসে যাচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্র । তাই দেশ ও জাতির বৃহৎ স্বার্থের কথা বিবেচনা করে, ইহকাল ও পরকালে আল্লাহ ও রাসূলের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সব ধরনের তোষামোদ ও খোশামোদ পরিহার করা একান্ত কর্তব্য। কারো প্রশংসা করতে হলে মাত্রাজ্ঞানের পরিচয় দেয়া এবং মধ্যপন্থা অবলম্বন করা আবশ্যক।
আল্লাহ তা’লা ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রেই আমাদেরকে তোষামোদের কুফল থেকে সুরক্ষা দান করুন। আমীন।
প্রচার: ১২ই ফেব্রুয়ারী ২০১৬ শুক্রবার সকাল ৬:৩০
প্রচার তরঙ্গ: এফএম-১০৬.০০
বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা।
ইসলাম ধর্মে বাস্তবসম্মত প্রশংসা অনুমোদিত হলেও, তোষামোদ বরাবরই নিন্দিত ও ঘৃণিত। কেননা তা তোষামোদকারী ও তোষামোদকৃত উভয় ব্যক্তির জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই প্রশংসার ক্ষেত্রে তোষামোদকে পরিহার করে, মাত্রাজ্ঞানের পরিচয় দেয়া ও মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা আবশ্যক।
কুরআনে কারীমে অবাস্তব প্রশংসা বা তোষামোদকে ইহুদী-খৃষ্টানদের বিশেষ বৈশিষ্ট হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। এ ব্যপারে সূরা তাওবায় আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন-
وَقَالَتِ الْيَهُودُ عُزَيْرٌ ابْنُ اللَّهِ وَقَالَتِ النَّصَارَى الْمَسِيحُ ابْنُ اللَّهِ ذَلِكَ قَوْلُهُمْ بِأَفْوَاهِهِمْ (سورة التوبة-৩০)
অর্থাৎ- ইহুদীরা বলে, আমাদের রাসূল উযাইর হলেন আল্লাহ তা’লার পুত্র। আর খৃষ্টানরা বলে, আমাদের রাসূল ঈসা মসীহ হলেন আল্লাহ তা’লার পুত্র। এগুলো মূলত তাদের মুখের অত্যুক্তি। (সূরা তাওবা-৩০) এই আয়াতের সমর্থনে সহীহ বুখারীর এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল সা.ও এই ধরনে প্রশংসা বা তোষামোদকে ইহুদী-খৃষ্টানদের স্বভাব আখ্যা দিয়ে ঘোষণা করেন- ইহুদী খৃষ্টানরা যেভাবে তাদের রাসূলদের অবাস্তব প্রশংসা করেছে তোমরা আমার ক্ষেত্রে এমন বাড়াবাড়ি বা তোষামোদি করো না।
কুরআনে কারীম ছাড়া বহু হাদীসেও আল্লাহর রাসূল সা. এই ধরনের অবাস্তব প্রশংসা বা তোষামোদকে কঠোর ভাষায় নিন্দা জানিয়েছেন। সহীহ মুসলিমের এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল সা. বর্ণনা করেন- ‘যখন তোমরা তোষামোদকারীদের সম্মুখীন হবে তখন তাদের চেহারায় মাটি নিক্ষেপ করো। (সহীহ মুসলিম-) উক্ত হাদিসটি তোষামোদকারীদের জন্য একটি সতর্কবার্তা। কারণ রহমত ও দয়ার ক্ষেত্রে যিনি অনুপম তিনিই এই সকল তোষামোদকারীদের চেহারায় মাটি নিক্ষেপ করতে বলেছেন।
অতিরিক্ত প্রশংসা বা তোষামোদ করা মূলত লজ্জাহীনতা ও অযোগ্যতার পরিচায়কও বটে। সাধারণত অযোগ্য এবং অকর্মণ্য ব্যক্তিরাই কিছু পার্থিব স্বার্থ হাসিলের জন্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের তোষামোদ করে। মন্দ দিকগুলো এড়িয়ে, শুধু অতিরঞ্জিত প্রশংসা করে তাদের নৈকট্য হাসিলের ঘৃণ্য প্রয়াসে লিপ্ত হয়। এদের ব্যপারে এক হাদিসে আল্লাহর রাসূল সা. বর্ণনা করেন- ‘দুর্বল ঈমানের পরিচয় হল, পার্থিব ধন-সম্পদের লোভে অন্যের অবাস্তব প্রশংসা করা বা তোষামোদ করা।’ এতে তোষামোদকৃত ব্যক্তি তুষ্ট হলেও পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
তোষামোদের কুফল বা ক্ষতির দিকগুলো আলোচনা করতে গিয়ে হযরত ইমাম গায্যালী রহ. তাঁর এক গ্রন্থে উল্লেখ করেন- অবাস্তব প্রশংসা বা তোষামোদ পাঁচটি ক্ষতি বয়ে আনে। তন্মধ্যে তোষামোদকারী ব্যক্তি তিনটি ক্ষতির সম্মুখীন হয় আর তোষামোদকৃত ব্যক্তি সম্মুখীন হয় দুটি ক্ষতির। তোষামোদকারী ব্যক্তি যে তিনটি ক্ষতির সম্মুখীন হয় তা হল-
এক. তোষামোদ করার মাধ্যমে তোষামোদকারী ব্যক্তি মূলত মিথ্যা ও প্রবঞ্চনার আশ্রয় নিয়ে থাকে। আর ইসলাম ধর্মে মিথ্যা বলা কবিরা গুনাহ বা মহাপাপ। এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল সা. এরশাদ করেন- ‘আমার উম্মত কখনো দুটি গোনাহ করতে পারে না। এক- মিথ্যা বলা। দুই- ধোঁকা দেয়া।’ সুতরাং তোষামোদকারী ব্যক্তি তোষামোদের মাধ্যমে কবিরা গোনাহের মত ভয়াবহ পাপে লিপ্ত হচ্ছে।
দুই. তোষামোদকারী ব্যক্তি তোষামোদের মাধ্যমে দ্বিতীয় যে ক্ষতির সম্মুখীন হয় তা হল- মুনাফেকি বা কপটতার শিকার হওয়া। অন্তরে একটা রেখে মুখে ভিন্ন কিছু প্রকাশ করাকে বলা হয় মুনাফেকি বা কপটতা। তোষামোদকারী ব্যক্তি বাস্তবতাকে অন্তরে গোপন রেখে মুখে ভিন্নটা প্রকাশ করে। জেনে-শুনে কপটতার আশ্রয় নেয়। সমাজ ও রাষ্ট্রকে বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। পরকালে সবচেয়ে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হবে এসকল মুনাফিকরা। কুরআনে কারীমে সূরা নিসায় আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন-
{ إِنَّ المنافقين فِي الدرك الأسفل مِنَ النار } [ النساء : ১৪৫ ]
অর্থাৎ- নিশ্চয় মুনাফিকরা জাহান্নামের সবচে’ নিম্নস্তরে থাকবে। (সূরা নিসা-১৪৫)
তিন. তোষামোদকারী ব্যক্তি তোষামোদের মাধ্যমে তৃতীয় যে ক্ষতির সম্মুখীন হয় তা হল- অন্যকে গোনাহে লিপ্ত করার ক্ষতি। কারণ, তোষামোদকৃত ব্যক্তি তোষামোদ শুনে নিজেকে বড় ও যোগ্য মনে করে। অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে থাকে। রিয়া বা লৌকিকতার শিকার হয়ে পড়ে। আর এগুলোর দায় বা গুনাহ মূলত তোষামোদকারী ব্যক্তির উপর বর্তায়।
অনুরূপভাবে তোষামোদকৃত ব্যক্তিও দুটি ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকে।
এক. তোষামোদকৃত ব্যক্তি অতিরিক্ত প্রশংসা শুনে আত্মম্ভরিতার শিকার হয়ে যায়। ফলে অন্তরে জন্ম নেয় অহংকার ও অহমিকার সর্বনাশা ব্যধি। যা তার সকল সদগুণকে ধ্বংশ করে দেয়। আর অহংকারী ও দাম্ভিককে আল্লাহ তা’লাও অপছন্দ করেন। কুরআনে কারীমে সূরা লুকমানে আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন-
إِنَّ الله لاَ يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ [ لقمان : ১৮ ]
অর্থাৎ নিশ্চয় আল্লাহ তা’লা অহংকারী ও দাম্ভিক ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না। (সূরা লুকমান-১৮)
দুই. তোষামোদকৃত ব্যক্তি দ্বিতীয় যে ক্ষতির সম্মুখীন হয় তা হল- মিথ্যা ও অতিরিক্ত প্রশংসা শুনে নিজের সম্পর্কে অনুরূপ ধারণা পোষণ করতে থাকে। অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে যোগ্য ভাবতে থাকে। পাশাপাশি মানুষের নিকট থেকে মিথ্যা প্রশংসাবাণী ও তোষামোদ শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। এ ধরনের ব্যক্তিদের কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে সূরা আল-ইমরানে আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন-
{ لاَ تَحْسَبَنَّ الذين يَفْرَحُونَ بِمَآ أَتَوْاْ وَّيُحِبُّونَ أَن يُحْمَدُواْ بِمَا لَمْ يَفْعَلُواْ فَلاَ تَحْسَبَنَّهُمْ بِمَفَازَةٍ مِّنَ العذاب وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ }
অর্থাৎ- যারা নিজেদের কৃতকর্মের ব্যপারে সন্তুষ্ট থাকে এবং কাজ ছাড়াই প্রশংসা শুনার জন্য উদগ্রীব থাকে তুমি মনে করো না যে, তারা আমার শাস্তি থেকে অব্যহতি লাভ করবে। (সূরা আল-ইমরান-১৮৮)
তোষামোদ মূলত মানুষের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাকে বিনষ্ট করে দেয়। কারণ, মানুষ যখন যোগ্যতার প্রয়োগ ছাড়াই প্রশংসা ও স্তুতি শুনতে পায় তখন মেধা ও শ্রম ব্যয় করতে আগ্রহী হয় না। ফলে আত্মতুষ্টিতে ভুগতে থাকে। আর আত্মতৃপ্তি ও আত্মতুষ্টি মানুষের শুধু উন্নতি ও অগ্রগতিকেই ব্যহত করে তা নয়, বরং ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের অবনতিকেও ত্বরান্বিত করে। কেননা গতিশীলতা হল সৃষ্টির স্বাভাবিক ধর্ম। তাকে ঊর্ধ্বমুখী না রাখলে অধঃগামী হবেই। অন্যদিকে তোষামোদ আর খোশামোদের আধিক্যের কারণে জাতীয় জীবনে আত্মসম্মান ও আত্ম পরিচয় বোধের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এরই ফলে পরষ্পর হানাহানি, কাাঁদা ছোঁড়াছুড়ি, দ্বন্দ, অবিশ্বাস বা মিথ্যাচারের সয়লাবে ভেসে যাচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্র । তাই দেশ ও জাতির বৃহৎ স্বার্থের কথা বিবেচনা করে, ইহকাল ও পরকালে আল্লাহ ও রাসূলের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সব ধরনের তোষামোদ ও খোশামোদ পরিহার করা একান্ত কর্তব্য। কারো প্রশংসা করতে হলে মাত্রাজ্ঞানের পরিচয় দেয়া এবং মধ্যপন্থা অবলম্বন করা আবশ্যক।
আল্লাহ তা’লা ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রেই আমাদেরকে তোষামোদের কুফল থেকে সুরক্ষা দান করুন। আমীন।
প্রচার: ১২ই ফেব্রুয়ারী ২০১৬ শুক্রবার সকাল ৬:৩০
প্রচার তরঙ্গ: এফএম-১০৬.০০
বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন