মৃত্যু এক অবধারিত সত্য। এই নশ্বর পৃথিবীতে যে
একবার জন্মেছে মৃত্যু তাকে আলিঙ্গন করবেই। মৃত্যু থেকে পালাবার কোন পথ
নেই। তাই
কুরআনে কারীমে আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন-
كُلُّ نَفْسٍ ذاَئِقَةُ الْمَوْتِ
“প্রত্যেক
প্রাণীকেই
মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।” (আল ইমরান- ১৮৫)
তিনি আরো বলেন:
“মৃত্যু
যন্ত্রণা অবশ্যই
আগমন
করবে, যা
থেকে তুমি অব্যাহতি চাচ্ছিলে।” (ক্বাফ-১৯) তাই প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য হল অধিকহারে মৃত্যুকে স্মরণ করা
এবং নেকআমল করার মাধ্যমে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। এসম্পর্কে নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “জীবনের স্বাদ বিনষ্টকারী (মৃত্যুর)
কথা তোমরা বেশী বেশী স্মরণ কর।” (তিরমিযী, নাসাঈ, ইরউয়া- ৬৮২)
মানুষের এই নশ্বর পৃথিবীতে আগমন করার সময় যেমন তার অভিভাবকের কতিপয় দায়িত্ব ও
কর্তব্য থাকে, তেমনি তার মৃত্যুর সময়ও
জীবিতদের কিছু করণীয় রয়েছে। আর এ সবকিছুই আমাদের পবিত্র দ্বীনে ইসলামে সবিস্তারে
বর্ণিত হয়েছে। কল্যাণের এমন কোন দিক নেই, যা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বাৎলে দিয়ে যান নি। অনুরূপভাবে
এমন কোন অকল্যাণ নেই, যা থেকে তিনি আমাদেরকে সতর্ক
করে যাননি।
ইসলাম মৃত মানুষের মর্যাদাও সমুন্নত রেখেছে। হালকা গরম পানি
দিয়ে গোসল দিয়ে, শুভ্র-সুন্দর পোশাক পরিধান করিয়ে, আতর-গোলাপ মাখিয়ে তাকে কবরস্থ করার নির্দেশ দিয়েছে। জানাজায় অংশগ্রহণ করে তার
সপক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার আদেশ দিয়েছে। এমনকি পাপাচারী মুসলমান মৃত্যুবরণ করলেও তার
জানাজা পড়তে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের ওপর (জানাজার) নামাজ
পড়া ওয়াজিব, চাই সে নেককার হোক বা বদকার, যদিও সে কবিরা গুনাহ করে। ’ (আবু দাউদ : ১/৩৫০)
ইসলামী শরিয়তে জানাজা, কাফন-দাফন
ইত্যাদি জীবিত মুসলমানদের ওপর মৃতদের অধিকার এবং অবশ্য পালনীয় ফরজ নির্দেশ। কোনো
মুসলমান মারা গেলে তার জানাজার নামাজ আদায় করা ফরজে কিফায়া। অর্থাত্ কিছুসংখ্যক
মুসলমান এ দায়িত্ব পালন করলে অন্যরা দায়িত্বমুক্ত হবে; যদিও এলাকার সব লোক ও আত্মীয়স্বজনের দায়িত্ব (সুন্নাত) হচ্ছে মৃতের জানাজা
ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করা এবং তার স্বজনদের সান্ত্বনা দেওয়া। সিহাহ সিত্তাসহ
(হাদিসের প্রসিদ্ধ ছয়টি গ্রন্থ) বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে মহানবী
(সা.) ইরশাদ করেছেন,
«من شهد الجنازة حتى يصلى عليها فله قيراط ومن شهدها حتى تدفن فله قيراطان» قيل يارسول الله: وما القيراطان ؟ قال: «مثل الجبلين العظيمين»
“যে ব্যক্তি কোনো মৃত ব্যক্তির জানাজার নামাজ আদায় করে, সে এক ‘কিরাত’ পরিমাণ নেকি লাভ করে আর যে ব্যক্তি কোনো মৃত ব্যক্তির জানাজার নামাজ আদায় করে
এবং তার দাফনের কাজে অংশগ্রহণ করে, সে দুই ‘কিরাত’ পরিমাণ সওয়াব লাভ করে।” কোনো এক সাহাবি
প্রশ্ন করল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! দুই কিরাত কী?’ নবী করিম (সা.) বললেন, ‘দুই কিরাতের ক্ষুদ্রতম কিরাত ওহুদ
পাহাড়ের সমান। ’ (ইবনে কাছির)
অন্য
এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«من تبع جنازة مسلم إيمانا واحتسابا وكان معها حتى يصلى عليها ويفرغ من دفنها فإنه يرجع بقيراطين كل قيراط مثل جبل أحد» (رواه البخاري)
“যে ব্যক্তি ঈমানের সহিত ও সাওয়াবের আশায় কোন মুসলিমের জানাযায় অংশ গ্রহন করল
এবং দাফন পর্যন্ত তার সাথে থাকল ও তার দাফন কর্ম শেষ করল, সে দু’কিরাত নেকি নিয়ে
ফিরবে, প্রত্যেক কিরাত ওহুদ পাহাড় পরিমাণ”। (বুখারি)
সাহাবি আব্দুল্লাহ ইব্ন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে
বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
«ما من رجل مسلم يموت فيقوم على جنازته أربعون رجلا لايشركون بالله شيئاً إلا شفعهم الله فيه»
“যদি কোন মুসলিম মৃত্যুবরণ করে, আর তার জানাযায়
চল্লিশ জন লোক এমন উপস্থিত হয়, যারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করে না, আল্লাহ মৃত ব্যক্তির ব্যাপারে তাদের সুপারিশ কবুল করবেন”। (মুসলিম)
হজরত উসমান (রা.) বর্ণনা করেন, “নবী করিম (সা.) যখন কোনো মৃত ব্যক্তির দাফনকাজ শেষ করতেন তখন তার কবরের পাশে
দাঁড়িয়ে সাহাবিদের বলতেন, ‘তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য ক্ষমা
প্রার্থনা করো এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করো তিনি যেন তাকে ইমানের ওপর দৃঢ় ও অবিচল
রাখেন। এখনই তার কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ’” (আবু দাউদ : হা.
৩২২১)
এরপর
তিনি এই দোয়া করতেন-
«اَللَّهُمَّ اغْفِرْ لَهُ, اَللَّهُمَّ اغْفِرْ لَهُ, اَللَّهُمَّ اغْفِرْ لَهُ, اَللَّهُمَّ ثَبِّتْهُ, اَللَّهُمَّ ثَبِّتْهُ, اَللَّهُمَّ ثَبِّتْهُ»
‘হে আল্লাহ! আপনি তাকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ! আপনি তাকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ! আপনি তাকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ! আপনি তাকে অবিচল রাখুন। হে আল্লাহ! আপনি তাকে অবিচল রাখুন। হে আল্লাহ! আপনি তাকে অবিচল রাখুন’।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, “একজন মুসলমানের
ওপর অন্য মুসলমানের ছয়টি অধিকার রয়েছে। এক. যখন কোনো মুসলমানের সঙ্গে দেখা হয় তখন
সালাম দেবে। দুই. কোনো মুসলমান ডাকলে সাড়া দেবে। তিন. সে তোমার কাছে সত্ পরামর্শ চাইলে
তুমি তাকে সত্ পরামর্শ দেবে। চার. কোনো মুসলমানের হাঁচি এলে হাঁচিদাতা ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললে জবাবে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলবে। পাঁচ. কোনো মুসলমান অসুস্থ হলে তার
সেবা-শুশ্রূষা করবে। ছয়. কোনো মুসলমান মৃত্যুবরণ করলে তার জানাজায় শরিক হবে।” (মুসলিম : হা. ২১৬২)
এসকল
আয়াত এবং হাদীস থেকে একথায় প্রতীয়মান হয় যে, কোন মুসলমান মৃত্যু বরণ করলে জীবিতদের
একান্ত কর্তব্য হল তার জানাযা এবং দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা এবং তাতে অংশগ্রহণ
করা। আল্লাহ তা’লা আমাদের সকলকে আমল করার সর্বাত্বক তাওফিক দান করুন। আমীন।
মুফতি
মাহমুদ হাসান
ইমাম
ও খতীব
আল-হেরা
জামে মসজিদ
জিগাতলা,
ধানমন্ডি, ঢাকা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন