এক.
ছোট্ট এক ছেলে আদনান। ক্লাস ফাইভে পড়ে। বাসা থেকে তার স্কুলের দূরত্ব বড়জোড় হাফ কিলো। ইচ্ছে করলেই সে একাকী স্কুলে আসা-যাওয়া করতে পারে। কিন্তু জনবহুল শহর বলে কথা। বিপদ-আপদের এখানে কোন বালাই নেই। তাই মা শিউলী বেগমই প্রতিদিন তাকে স্কুলে দিয়ে আসে এবং ছুটি হলে সাথে করে নিয়ে আসে। এটা এখন শিউলী বেগমের নিত্যদিনের রুটিনে পরিণত হয়েছে।
দুই.
শিউলী বেগমের চোখ একটা অন্ধ। এ নিয়ে পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে তিনি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার। কিন্তু, এখন তিনি এসব আর গায়ে মাখেন না। আতুঁর ঘরে থাকতেই আদনানের বাবা আকরাম সাহেব মারা যান। তাই সংসারের সকল গ্লানী শিউলী বেগমকেই টানতে হয়। কিন্তু একমাত্র ছেলে আদনানের মুখের দিকে চেয়ে সব কষ্ট-ক্লেশ বরণ করে নেন হাসি মুখে। তিনি স্বপ্ন দেখেন আদনান খেলা-পড়া শিখে একদিন অনেক বড় হবে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে। সেদিন তাঁর সংসারের অভাব অনটন, দুঃখ-কষ্ট বিদায় নেবে। এই আশায় বুক বেঁধে তিনি আদনানকে পড়া-লেখা শেখাচ্ছেন।
তিন.
এক সকালে স্কুল থেকে ফেরার পথে আদনান তার মাকে বলল- মা! কাল থেকে তুমি স্কুলে এসো না আমি একাই আসা-যাওয়া করবো। কারণ তোমার এক চোখ অন্ধ। এনিয়ে সহপাঠীরা আমাকে তিরষ্কার করে। ওদের সামনে আমি মুখ দেখাতে পারিনা’ ছেলের কথা শুনে শিউলী বেগম সহসা হোঁচট খেলেন। ভেতরে খুব চোট পেলেন বটে। কিন্তু প্রকাশ করলেন না। বরং সহপাঠীদের কাছে ছেলের ‘প্রেস্টিজের’ কথা ভেবে পরদিন থেকে তিনি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন।
চার.
বছর কয়েক পর। আদনানের পড়া লেখা তখন শেষ। সমাজের এখন সে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। শহরের গণ্যমান্য শিল্পপতিদের মধ্যে সেও তখন একজন। দেশের হোমরা-চোমরা মন্ত্রী-এমপিদের সাতে তার উঠা-বসা। বাসায় সর্বদা নামী-দামী ব্যক্তিদের আনাগোনা।
ছেলের এই প্রতিষ্ঠা দেখে শিউলী বেগমের তখন আনন্দের ইয়াত্তা নেই। ছেলেকে নিয়ে তার এখন অনেক গর্ব। স্বামী হারানোর বেদনা, অন্ধত্বের গ্লানী, সংসারের দুঃখ-কষ্ট সব এখন মুছে গেছে প্রাচুর্যের বন্যায়। তার জীবনের সকল আশা-প্রত্যাশা এখন ষোলকলায় পূর্ণ। কিন্তু আদনান তার মাকে নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। তার বাসায় যখন ঊর্ধ্বতন গোছের কেউ আসে আর দেখে যে, তার মায়ের এক চোখ অন্ধ তখন সেটা আদনানের প্রেস্টিজে বড় হয়ে বাঁধে। শিউলী বেগমকে তখন নিজের মা বলে পরিচয় দিতে তার আত্মশ্লাত্বায় লাগে। তাই ভেবে চিন্তে আদনান একদিন তার মাকে বলল, ‘মা তুমি এখানে থাকলে আমার একটু প্রবলেম হয়। আমার বন্ধু-বান্ধবরা এসে যখন দেখে তোমার এক চোখ অন্ধ তখন ওদের সামনে নিজেকে আমার খুব ছোট মনে হয়। তাই আমি তোমাকে কোন বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবো এবং খোঁজ-খবর রাখবো। তোমর কোন কষ্ট হবে না।’ ছেলে-বউ, নাতি-নাতনী, বাড়ি-ঘর, সংসার এতসব সুখ-শান্তি ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই নিতে হবে এমনটা শিউলী বেগম কোনদিন কল্পনাও করেনি। কিন্তু ছেলের প্রেস্টিজের কথা ভেবে কষ্টের পাহাড় বুকে চেপে শিউলী বেগম একদিন আশ্রয় নিলেন এক বৃদ্ধাশ্রমে।
পাঁচ.
শিউলী বেগম থাকেন বৃদ্ধাশ্রমে। কিন্তু তার মন পড়ে থাকে তার ছেলের বাসায়। সকল চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু একমাত্র ছেলে আদনান। বৃদ্ধ বয়সে মানুষ ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনীকে কাছে পেতে চায়। তাদের জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর গল্পশুনাতে চায়। কিন্তু শিউলী বেগমের জীবনেতা আর হয়ে উঠে না।
প্রথম দিকে আদনান সপ্তাহান্তে মাকে একবার দেখে যেত। আদনানকে দেখেই শিউলী বেগম ভুলে যেতেন বৃদ্ধাম্রমের সকল দুঃখ-দুর্দশা। পরম মমতায় জড়িয়ে ধরতেন ছেলেকে।
মাস কয়েক যেতে না যেতেই আদনানের ব্যস্ততা বেড়ে যায় বহুগুণে। সপ্তাহে একবার মাকে দেখে যাওয়ার মত সুযোগ এখন আর হয়ে উঠেনা। মাসে বা দুই মাসে একবার এসে শুধুমাত্র খোঁজ খবর নিয়ে যায়।
আরও কিছুদিন পর একটা সময় আসে, যখন আদনান মায়ের কথা অনেকটা ভুলে যায়। সময়ের অভাবে বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী-পরিজন নিয়েই সে ব্যস্ত সময় কাটায়। মাকে নিয়ে ভাববার মত সামান্যতম ফুরসত এখন তার ভাগ্যে জোটে না।
অন্যদিকে ছেলেকে না দেখার কষ্টে শিউলী বেগমের ভেতরটা প্রায়শই হাহাকার করে উঠে। হৃদয় পড়ে ভেসে উঠে- স্বামীর মুখচ্ছবি, ছোট্ট আদনানের দূরন্ত স্মৃতি। জীবনের অনেকটা পথ তিনি হেঁটেছেন একা স্বামীহারা। কিন্তু একমাত্র ছেলে আদনানই ছিল চলতি পথের অনুপ্রেরণা। ছেলের মুখের দিকে চেয়ে তিনি সমাজ ও জীবনের সকল কষ্ট মেনে নিয়েছেন অকাতরে। কিন্তু জীবন সায়াহ্নে এসে ছেলেও তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে- শুধুমাত্র তার এক চোখ অন্ধ বলে এসব কিছু ভাবতে ভাবতে শিউলী বেগমের চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে। অজান্তেই গন্ডদেশ বেয়ে নেমে আসে অশ্র“র ধারা।
ছয়.
বছর ছয়েক পর। হঠাৎ করেই আদনান তার মাকে দেখতে বৃদ্ধাশ্রমে গেল। সেখানে গিয়ে শুনতে পেল, তার মা শিউলী বেগম বছর খানেক আগইে পরপারে পাড়ি জমেিয়ছেন।
জীবনের শেষ কটা দিন শিউলী বেগম ছেলেকে দেখার জন্য খুব কাকুতি-মিনতি করেছিলেন। শেষ তক আদনানের জন্য একটি চিঠি রেখে গেছেন। মা ছিলেন জীবিত। তাই এতদিন আদনানের অনুভুতি ছিল ভাবলেশহীন। আজ মায়ের মৃত্যু সংবাদ তাকে বিচলিত করে তুলল। নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল। মনে হল মায়ের মৃত্যুর জন্য সেই দায়ী। অনুতপ্ত হৃদয়ে মায়ের রেখে যাওয়া চিঠিটা নিয়ে বাসার পথে পা বাড়ায় আদনান।
সাত.
বাসায় গিয়ে খামটা ছিঁড়ে চিঠিটা পড়তে শুরু করে আদনান-
‘বাবা আদনান! তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু বেঁচে থাকতে সেটা হয়ত আর সম্ভব হবে না। তবে দোয়া করি সারা জীবন তুমি খুব সুখে থাকো।
বাবা! একটা কথা তোমাকে কখনো বলতে পারিনি। ভেবেছিলাম জীবন সায়াহ্নে বলবো। কিন্তু সেটাও আর হল না। তাই কাগজে-কলমে রেখে যাচ্ছি। তুমি পড়ে নিও। তুমি আমাকে অবহেলা করতে কারণ আমার একটি চোখ অন্ধ। এ কারণেই জীবনের শেষ দিনগুলো পুত্র-স্বজনহীন একা একা বৃদ্ধাশ্রমে কাটিয়েছি। কিন্তু তুমি তো কোন দিন জানতে চাওনি- কেন আমার এক চোখ অন্ধ?
আজ তোমাকে বলছি। কী কারণে আমার বাম চোখ অন্ধ হয়েছি, তুমি তখন খুব ছোট্ট। কিছুই বুঝতে শেখনি। হঠাৎ এক দুর্ঘটনায় তোমার বাম চোখটি নষ্ট হয়ে যায়। ফলে অপারেশন করে সেটাকে উপড়ে ফেলতে হয়। তোমার জীবন তখন সবে মাত্র শুরু। সারাটি জীবন তোমার এক চোখ অন্ধ হয়ে থাকবে। মানুষ তোমাকে হেয় করবে, সমাজে তুমি প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারবে না, মা হয়ে এটা আমি মেনে নিতে পারিনি। তাই অপারেশনের মাধ্যমে আমার একটা চোখ তোমাকে দিয়েছিলাম। তোমার বাম চোখটা মূলত আমার চোখ।
আজ তুমি তোমার চারপাশকে দু’ চোখ ভরে দেখছো। সমাজ জীবনে নিজেকে চূড়ান্ত শিখরে অধিষ্ঠিত করতে পেরেছ। মা হয়ে এটাই আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। আজ আমি অন্ধ বলে আমার কোন মনোবেদনা নেই। তুমি দু’ চোখ মেলে সব দেখছো। তাই আমি আজ সবচে’ সুখী। ভাল থেকো বাবা! সুখে থেকো!
-ইতি
তোমার অন্ধ মা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন