ইসলামে শহীদের মর্যাদা


আল্লাহ তা’লা মানুষকে সৃষ্টি করার পর পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তার প্রতিনিধি হিসেবে। দুনিয়াতে মানুষ আল্লাহ তা’লার ইবাদত করবে এবং তারই প্রতিনিধিত্ব করবে। আল্লাহ প্রদত্ত বিধানাবালী নিজে পালন করবে এবং সমাজে বাস্তবায়নের জন্য নিরলস চেষ্টা-সাধনায় লিপ্ত হবে। আল্লাহর যমীনে আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের এই সংগ্রামে যে ব্যক্তি নিজের জীবনকে উৎসর্গ করবে তাকেই ইসলামের পরিভাষায় শহীদ বলা হয়। শহীদএকটি আরবি শব্দ। এটি শাহাদশব্দ থেকে গঠিত হয়েছে। শাহাদঅর্থ হল-সাক্ষ্য দেয়া, সনদ বা প্রত্যয়নপত্র প্রদান করা, উপস্থিত হওয়া ইত্যাদি। শহীদ ব্যক্তি যেহেতু মহান আল্লাহ তা’লার সন্তুষ্টি অর্জনের সফলতায় স্বীয় জীবন উৎসর্গের মাধ্যমে তার ঈমানের দাবি পূরণের সত্যতার সাক্ষ্য প্রদান করে তাই তাকে শহীদ বলা হয়।
ইসলামে শহীদের মর্যাদা অপরিসীম। যে ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে শুধুমাত্র মহান আল্লাহ তা’লার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যেই দ্বীনের পথে শহীদ হয়েছে তার জন্য আল্লাহ তা’লার দরবারে রয়েছে সুউচ্চ মর্যাদা। কুরআনে কারীমের বহু আয়াতে এবং রাসূলে কারীম সা. এর অসংখ্য হাদীসে শহীদদের অগণিত মর্যাদার কথা উল্লেখ রয়েছে। শহীদের মর্যাদা সমর্কে প্রসিদ্ধ কিছু আয়াত ও হাদীস এখানে আলোচনা করা হল।
(১) শহীদের মর্যাদা সম্পর্কে কুরআনে কারীমের সূরা বাকারার ১৫৪ নাম্বার আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
و لا تقولوا لمن يقتل فى سبيل الله أمواتابل أحياء و لكن لا تشعرون.
 আল্লাহ পথে যারা শহীদ হয়, তাদেরকে তোমরা মৃত বল না, বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা উপলব্ধি করতে পার না(সূরা আল-বাকারা:১৫৪)।
এরপর সূরা আল ইমরানের ১৬৯ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তা’লা ইরশাদ করেছেন-যারা আল্লাহর পথে শহীদ হয়েছে তোমরা তাদেরকে মৃত মনে কর না, বরং তারা জীবিত এবং তাদের রবের পক্ষ থেকে তারা রিযিক প্রাপ্ত(সূরা আল-ইমরান: ১৬৯)
এই দুটি আয়াতেই মহান আল্লাহ তা’লা শহীদদেরকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। দুনিয়ার জীবিত মানুষের চর্মচক্ষে তাদেরকে প্রাণহীন মৃত লাশ মনে হলোও আসলে মহান আল্লাহ নিকট তারা জীবীত, তাদেরকে মৃত মনে করতে ও মৃত বলতে নিষেধ করা হয়েছে। শহীদদের মৃত্যুকে অন্যদের মৃত্যুর সমপর্যায়ভুক্ত মনে করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা শহীদদেরকে অন্যান্য মৃতের তুলনায় একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মর্যাদা দান করা হয়েছে। এ কারণেই অনেক সময় দেখা যায়, শহীদদের রক্ত-গোস্তের দেহ পর্যন্ত মাটিতে বিনষ্ট হয় না। জীবিত মানুষের দেহের মতোই অবিকৃত থাকতে দেখা যায়। (মুফতী মম্মদ শফী রহ., তাফসীর মাআরেফুল কুরআন-১/৩৯৬)।
(২) শহীদগণ আল্লাহর পুরস্কার পেয়ে হয় আনন্দিতকুরআনে কারীমের সূরা আল-ইমরানের ১৭০-১৭১ নাম্বার আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে শহীদদেরকে যা দিয়েছেন তাতে তারা আনন্দিত এবংতাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না, আল্লাহর নিয়ামত ও অনুগ্রহের জন্য তারা আনন্দ প্রকাশ করে এবং তা এ কারণে যে, আল্লাহ্ মুমিনদের শ্রমফল বিনষ্ট করেন না” (সূরাআল-ইমরান:১৭০-১৭১)।
(৩) শহীদদের একটি বিশেষ মর্যাদা হল, তারা নিজেদের এই সম্মানজনক পুরস্কার দেখে পুনরায় শহীদ হওয়ার জন্য দুনিয়ায় ফিরে আসার আকাঙ্খা প্রকাশ করবেবিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ সহীহ বুখারীর এক হাদীসে এসেছে, হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: একমাত্র শহীদ ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি মৃত্যুর পরে দুনিয়ায় ফিরে আসতে চাইবে নাশুধুমাত্র শহীদ ব্যক্তিই জান্নাতে যাওয়ার পর পুনরায় দুনিয়াতে ফিরে আসার আকাঙ্খা করবে। কারণ শাহাদাতের বিনিসময়ে সে আল্লাহর নিকট এমন কল্যাণপ্রাপ্ত হয়েছে যা দুনিয়া ও তার সমস্ত সম্পদের সমান। সে বাস্তবে শাহাদতের এই অবর্ণনীয় মর্যাদা দেখপুনরায় দুনিয়ায় ফিরে এসে আর একবার আল্লাহর পথে প্রাণ দিয়ে শহীদ হতে আনন্দ অনুভব করবে (সহীহ আল-বুখারী, কিতাবুল জিহাদ-১/৩৯২)। এই আকাঙ্খা শুধু শহীদরা জান্নাতে যাওয়ার পর করবে তা নয়; বরং আল্লাহর রাসূল সা. দুনিয়াতে থাকতেই বারবার আল্লাহর পথে শহীদ হওয়ার আকাঙ্খা প্রকাশ করতেন। এ সম্পর্কে সহীহ বুখারীর কিতাবুল জিহাদের এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন- সেই সত্তার শপথ যাঁর মুঠির মধ্যে আমার প্রাণ, আমার নিকট অত্যন্ত পছন্দনীয় হচ্ছে, আমি আল্লাহর পথে শহীদ হয়ে যাই, অতপর জীবন লাভ করি এবং পুনরায় শহীদ হই, তারপর আবার জীবন লাভ করি এবং পুনরায় শহীদ হই, তারপর আবার জীবন লাভ করি এবং পুনরায় শহীদ হই” (সহীহ বুখারী-১/৩৯২)।
(৪) শহীদদে আরেকটি বিশেষ মর্যাদা হল, তাদের মৃত্যুকষ্ট সামান্য চিমটি কাটার চেয়ে বেশি হয় নাএসম্পর্কে তিরমিযীর এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন-শহীদ ব্যক্তি মৃত্যুর সময়সামান্য একটু চিমটি কাটার মতো স্পর্শ অনুভব করে মাত্র” (জামেতিরমিযী-১/২৯৬)। অর্থাৎ যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষ নিহত হওয়ার সময় সাধারণত মারণাস্ত্রের আঘাতে যে ধরনের অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে থাকে তা ভয়াবহ কষ্টদায়ক হয়ে থাকেকিন্তু আল্লাহর পথে শহীদ ব্যক্তি তীর-তলোয়ারের আঘাতে হোক কিংবাগুলি-বোমার আঘাতে হোক অথবাপানিতে ডুবে কিংবাআগুনে পুড়ে হোকযেভাবেই সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করুক সামান্য একটু চিমটি কাটার চেয়ে বেশি কষ্ট সে অনুভব করে না। এটা শহীদের জন্য মহান আল্লাহ বিশেষ মর্যাদা ও রহমত।
(৫) শহীদের অন্যতম আরেকটি মর্যাদা হল, মানুষের পাওনা ঋণ ছাড়া শহীদের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়সহীহ মুসলিমের এক হাদীসে রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন- “শহীদের ঋণ ছাড়া তার সকল গুনাহ শাহাদত প্রাপ্তির কারণে ক্ষমা হয়ে যায়” (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ইমারত-২/১৩৫)। কিন্তু ঋণ যেহেতু মানুষের অধিকার, তা পাওনাদার থেকে ক্ষমা না পাওয়া পর্যন্ত আল্লাহ তা’লাও তা ক্ষমা করেন না।
() এছাড়াও শহীদের জন্য মহান আল্লাহর নিকট রয়েছে আরো বিশেষ কিছু মর্যাদাএক হাদীসে এমন বিশষ ছয়টি মর্যাদার কথা বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন, আল্লাহর নিকট শহীদের ছয়টি (বিশেষ) মর্যাদা রয়েছে: . শহীদের শরীর থেকে প্রবাহিত রক্তের প্রথম ফোঁটা মাটিতে পড়ার সাথে সাথে তাঁর সকল গুনাহ ক্ষমা করা হয়। . শাহাদাতের সময় জান্নাতে শহীদের আবাসস্থান দেখানো হয়। . শহীদের কবরে আযাব হবে না এবংসে কিয়ামতের বিভীষিকা থেকে নিরাপদ থাকবে. শহীদের মাথায় কিয়ামতের দিন ইয়াকুত পাথরের তৈরী সম্মানের টুপি পরানো হবে, যার একটু ইয়াকুত পাথর দুনিয়া ও দুনিয়ার সকল সম্পদ থেকে উত্তম.প্রত্যেক শহীদের সাথে বাহাত্তর জন পবিত্রা জান্নাতী হুরের বিয়ে দেয়া হবে. শহীদকে তাঁর নিকটাত্মীয়দের থেকে সত্তরজন লোকের জন্য সুপারিশ করার ক্ষমতা দেয়া হবে (জামেতিরমিযী, আবওয়াবুল ফাদায়িলিল জিহাদ ১/২৯৫)।
দ্বীনের পথে লড়াই করতে গিয়ে যারা মৃত্যুবরণ করে তাদেরকে প্রকৃত শহীদ বলা হয়। এছাড়াও কিছু দুর্ঘটনা ও রোগ আছে যেগুলোর কারণে মৃত্যু হলে ইসলামে শাহাদাতের মর্যাদা দেয়া হয়। এবং আল্লাহ তা’লার নিকট তাকে শহীদের মর্যাদা পেয়ে থাকেএ সম্পর্কে নাসায়ী শরীফের এক হাদীসে এসেছে- রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “আল্লাহ্‌র রাস্তায় যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছে এরূপ ব্যক্তি ছাড়াও সাত শ্রেণীর লোক শহীদের মর্যাদা পাবে() যে ব্যক্তি মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেছে। () যে ব্যক্তি পানিতে ডুবে মারা গেছে। () যে ব্যক্তি শ্বাসকষ্ট রোগে মারা গেছে () যে ব্যক্তি পেটের রোগে মারা গেছে। () যে ব্যাক্তি আগুনে পুড়ে মারা গেছে() যে ব্যক্তি কোন কিছুর নিচে চাপা পড়ে কিংবা পিষ্ট হয়ে মারা গেছে। () যে নারী সন্তানেরপ্রসব বেদনায় মৃ্ত্যু বরণ করেছে” (সুনানে নাসাঈ)
তাবরানীর এক হাদীসে শহীদের আরেক প্রকার সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই তোমাদের পিছনে রয়েছে ধৈর্যের যুগ। সে সময়ে যে ব্যক্তি সুন্নাতকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে থাকবে, সে তোমাদের সময়ের ৫০ জন শহীদের মর্যাদা পাবে।(ত্বাবারানী, আল-মুজামুল কাবীর হা/১০২৪০)
আল্লাহ তা’লা আমাদেরসকলকে প্রকৃত শাহাদাতের মর্যাদা হাসিল করার তাওফীক দান করুন।

মুফতি মাহমুদ হাসান
ইমাম ও খতীব
আল-হেরা জামে মসজিদ

জিগাতলা, ধানমন্ডি, ঢাকা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন