বাংলাদেশে মিশনারীদের অপতৎপরতা : দাওয়াত ও তাবলীগের গুরুত্ব

বর্তমান পৃথিবীতে যতগুলো ধর্ম আছে তন্মধ্যে সবচে’ সঠিক ও নির্ভরযোগ্য ধর্ম হল ইসলাম। কারণ এই ধর্ম সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা বলেন- “আমি তোমাদের জন্য একমাত্র ইসলাম ধর্মকেই মনোনীত করেছি।” (সূরা মায়েদা-৩)। আর যারা আল্লাহর মনোনীত এই ইসলাম ধর্মকে অনুসরণ করবে তাদেরকে আল্লাহ শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ইরশাদ করেছেন- “তোমরা হলে সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। মানুষের কল্যাণের জন্যই তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে।” (সূরা আলে ইমরান-১১০)। কিন্তু ইসলাম ধর্মের ও মুসলিম জাতির এই শ্রেষ্ঠত্ব পৃথিবীর অন্যান্য জাতি ও ধর্মের লোকেরা কখনো মেনে নিতে পরেনি। বিশেষত ইহুদি-খৃস্টান ও আহলে কিতাবীগণ। তাই যুগে যুগে তারা ইসলাম ও মুসলমানদেরকে সমূলে ধ্বংস করার লক্ষ্যে  এবং তাদের ঈমান ও আমালকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য   নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। যেমন কোরআনে বর্ণিত হয়েছে- “আহলে কিতাবীদের অনেকেই হিংসাবশত: চায় যে, মুসলমান হওয়ার পর তোমাদেরকে কোন প্রকারে আবার কাফির বানিয়ে দিতে।” (সূরা বাকারাহ-১০৯)। অন্য আয়াতে এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে- “নি:সন্দেহে যেসব লোক কাফের তারা নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে তোমাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য। (সূরা তাওবাহ-৩৬)

হিংসা ও বিদ্বেষবশত: ইসলামের শুরু লগ্ন থেকেই আহলে কিতাবীরা মুসলমানদেরকে ইসলাম ধর্ম থেকে বিচ্যুত করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত । তাদের ষড়যন্ত্র আর নীল নকশা থেকে বাদ যায়নি মুসলিম অধ্যুষিত এই বাংলাদেশও। ষোল শতকের মুঘল শাসনামলে বাদশা আকবরের যুগে বাণিজ্যের নাম করে বাংলার মাটিতে সেই যে ঘাঁপটি মেরে বসেছিল তারা; আজও যায়নি। বরং শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে ষড়যন্ত্রের ডালপালা ছড়িয়ে দিয়েছে বাংলার ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে। বর্তমানে দারিদ্র্য-ক্ষুধা, খরা-বন্যা, দু:খ-দুর্দশা ও কষ্ট-যাতনাকে তারা মুসলমানদের ঈমান ছিনিয়ে নেয়ার এক সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে। বিভিন্ন ধাতব্য সংস্থা ও সাহায্য সংগঠন নামে প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র মুসলমানদের হাতে তুলে দিচ্ছে দু’মুঠো ভাত আর কেড়ে নিচ্ছে মুসলমানদের অমূল্য সম্পদ ঈমান। এভাবে ধীরে ধীরে বাংলাদেশে মুসলমানদের ধর্মান্তরের প্রক্রিয়া ব্যপক থেকে ব্যপকতর হচ্ছে। সাথে সাথে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম এই মুসলিম দেশে খৃস্টানদের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে ব্যপকহারে।  

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে- “১৮৮১ সনে বাংলাদেশে প্রতি ৬০০০ জনে একজন খৃস্টান ছিল। ২০০০ সনে এসে তা দাঁড়ায় প্রতি ১১ জনে একজন। ২০১৫ সনে মিশনারীদের লক্ষ্য হল, প্রতি ৩ জনে  একজন খৃস্টান বানানো।” (সূত্র-Bangladesh in the web creeping coloniasm : 68p)  
অপরদিকে খৃস্টধর্ম প্রচারক জেমস তার অনুসারীদের উদ্দেশ্যে বলেন- “তোমাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল মুসলিমকে ইসলাম ধর্ম থেকে বের করে নিয়ে আসা। যেন সে এমন এক সৃষ্টে পরিণত হয় যার সাথে আল্লাহর কোন  সম্পর্ক নেই।” (সূত্র- তানছিরুল মুসলিমীন : ২০পৃ)। 
এছাড়াও বিভিন্ন সময় পত্র-পত্রিকায় ধর্মান্তরের যে খণ্ড চিত্র উঠে এসেছে তাতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে মুসলমানদের ঈমান হরণের এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে এই খৃস্টান মিশনারিরা।

ধর্মান্তর প্রতিরোধে দাওয়াত ও তাবলীগ:

আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন তাঁদের প্রধান দায়িত্ব ছিল ‘দাওয়াত ইলাল্লাহ’। তথা মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করা। এবং মানুষের মাঝে দ্বীনের তাবলীগ করা। তথা দ্বীনের সঠিক বাণী মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়া। এজন্যই আল্লাহ তাআলা আমাদের নবীকে কোরআনে ‘দাঈ ইলাল্লাহ’ খেতাবে ভূষিত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে- وَدَاعِيًا إِلَى اللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُنِيرً অর্থ- “আর আল্লাহর নির্দেশক্রমে তাঁর দিকে আহ্বায়করূপে এবং উজ্জ্বল প্রদীপরূপে” (সূরা আহযাব-৪৬)। 
আমাদের নবী যেহেতু শেষ নবী, কেয়ামত পর্যন্ত আর কোন নবী আসবে না। তাই বর্তমানে দাওয়াত ও তাবলীগের এই গুরু দায়িত্ব সকল মুসলিমের জন্য অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। 

সাধারণত দুটি কারণে মুসলমানরা ধর্মান্তরিত হয়ে থাকে। 
এক. দ্বীন ও ঈমানের ব্যপারে সীমাহীন অজ্ঞতা। 
দুই. পার্থিব আর্থিক দৈন্যতা। 
তবে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে প্রতীয়মান হয় যে, ধর্মান্তরের পেছনে মৌলিক কারণ একটি। তা হল- দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে সীমাহীন অজ্ঞতা। আর্থিক দৈন্যতা নয়। কারণ, দরিদ্রতা বা আর্থিক দৈন্যতা পৃথিবীর সর্বযুগেই ছিল। ধনী-গরীব শ্রেণীভেদ নবী সা. ও সাহাবায়ে কেরামের যুগেও ছিল। দু:খ-দুর্দশা সাহাবায়ে কেরামকেও আক্রান্ত করেছিল। কিন্তু এই দরিদ্রতা ও  দু:খ-দুর্দশা সাহাবায়ে কেরামের ঈমানের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পারেনি। বরং দরিদ্রতা সম্পর্কে রাসূল সা. বলেছেন- “আমি তো তোমাদের ব্যপারে দরিদ্রতার  কোন আশংকাই করি না। বরং আমার আশংকা হয়, অচিরেই দুনিয়ার ধন-দৌলত ও প্রাচুর্য তোমাদের পেয়ে বসবে। যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের পার্থিব ঐশ্বর্যের মোহ পেয়ে বসেছিল। ফলে তোমরা ধন-সম্পদ নিয়ে পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। যেমনটা করেছিল তোমাদের পূর্ববর্তীগণ। অবশেষে এই ঐশ্বর্যই তোমাদের ধ্বংস ডেকে আনবে। যেমন ঐশ্বর্য তোমাদের পূর্ববর্তীদের ধ্বংস ডেকে এনেছিল।” (সহীহ আল বুখারী-৩১৫৮)। 

সুতরাং ধর্মান্তরের পেছনে দরিদ্রতা বা অভাব-অনটন মুখ্য কোন কার্যকারণ নয়। এটা সকল যুগের, সকল ধর্মের, সকল জাতির মানুষের মাঝেই ছিল, আছে এবং থাকবে। বরং ধনাঢ্য-দরিদ্র এটা খোদা প্রদত্ত বিধান। তাই তো কোরআনে এরশাদ হয়েছে- “পার্থিব জগতে জীবনোপকরণকে আমিই তাদের মাঝে বণ্টন করে দিয়েছি। এবং কতককে কতকের উপর প্রাধান্য দিয়েছি (ধনাঢ্য বানিয়েছি)। যেন তাদের কতক (ধনাঢ্য ব্যক্তিরা) কতককে (দরিদ্রদেরকে) অধীনস্ত হিসেবে গ্রহণ করতে পারে।” (সূরা যুখরুফ-৩২)। 
অতএব মুসলমানদের ঈমান হারা হওয়ার পেছনে মূল কারণ হল দ্বীন ও ঈমান সম্পর্কে তাদের সীমাহীন অজ্ঞতা। অপরদিকে সাহাবায়ে কেরাম দ্বীন-ঈমান সম্পর্কে এমন অজ্ঞ ছিলেন না। বরং তাঁরা জানতেন, দরিদ্রতা, অভাব-অনটন সাময়িক; এই কষ্ট দু’দিনের।  কিন্তু ঈমানের দৌলত চিরকালের; এর বিনিময়ে রয়েছে চিরস্থায়ী জান্নাত। এই য়াকীন ও বিশ্বাস থাকার কারণে সাহাবায়ে কেরাম কখনো সামান্য দারিদ্র্যের কষ্ট ঘুচাতে মূল্যবান ঈমানকে বিকিয়ে দিতেন না। আর বর্তমান যুগে, আমাদেরও দরিদ্রতা আছে, অভাব-অনটন আছে, দু:খ-দুর্দশা আছে, কিন্তু দ্বীন ও ঈমানের ব্যপারে সাহাবায়ে কেরামের সেই য়াকীন ও বিশ্বাস নেই। তাই সামান্য দু’মুঠো অন্নের  বিনিময়ে বিকিয়ে দেই নিজেদের দ্বীন-ঈমান।

দ্বীন-ধর্মের ব্যপারে মানুষের এই সীমাহীন অজ্ঞতা-মূর্খতা দূর করে ইসলামের সঠিক দীক্ষা ও বিশ্বাসে উজ্জীবীত করে তুলতে দাওয়াত ও তাবলীগের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এবং অধিক পরিমাণে মুসলমানদের মাঝে দ্বীন-ঈমানের সঠিক জ্ঞানের প্রচার-প্রসার করে দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে মুসলমানদের এই ধর্মান্তর রোধ করা সম্ভব। মূলত এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পেরেই মানুষের মাঝে দাওয়াত ও তাবলীগের ব্যপক প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে ১৯২৬ সনে মাওলানা ইলিয়াছ রহ. ‘তাবলীগ জামাত’ প্রতিষ্ঠা করেন। শ্লোগান ছিল- ‘হে মুসলিমগণ! মুসলিম হও।’ যা মূলত কোরআনের এই আয়াতেরই মর্মার্থ- “হে ঈমানদারগণ! তোমারা পরিপূর্ণরূপে ইসলামের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাও। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চিতরূপে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” (সূরা বাকারা-২০৮)। 
সেই থেকে বিশ্বের আনাচে-কানাচে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে দাওয়াত ও তাবলীগের এই মিশন। এই তাবলীগ জামাতের উসিলা করে আজ  হাজার হাজার বিধর্মীও আশ্রয় নিচ্ছে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে। আর মুসলমানদের মাঝে এই দাওয়াত ও তাবলীগ সৃষ্টি করেছে দ্বীন ও ঈমানের এক নব জাগরণ। এমনকি মাওলানা মওদুদী সাহেব এই তাবলীগ জামাতের লোকদের ব্যপারে বলতে বাধ্য হয়েছেন- “মাওলানা (ইলিয়াছ রহ.) সাধারণ গ্রামবাসীদের মধ্যে তাঁর এ তাবলীগী কাজের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি আর সৎকাজের প্রতি আহবান ও অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকার গতিময় উদ্দীপনা সঞ্চার করেছেন। ......................... এরা পারিবারিক কাজ-কর্ম শেষ করেই বিভিন্ন গ্রাম থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল নিয়ে তাবলীগের কাজে বেরিয়ে পড়ছে। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ছুটে গিয়ে তারা একে অপরকে কল্যাণ ও আত্মশুদ্ধির প্রতি আহ্বান করছে। তারা নিজেদের মালামাল নিজেরাই বহন করছে। নিজের বোঝা অপরের কাঁধে চাপিয়ে দেয় না। এবং নিজের জন্য কারো কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে না; বরং এর বদলে তাদের উদ্দেশ্য হল একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ। না এরা কোন অপ্রয়োজনীয় কাজ করে; আর না আছে এদের মধ্যে পার্থিব কোন লোভ-লালসা। সুতরাং যেখানেই তারা অবস্থান করেছে, সেখানেই জনসাধারণের মাঝে এক অসাধারণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।” (সূত্র- ‘তরজমানুল কুরআন’, ১৩৫৮ হিজরীর শাবান সংখ্যা। ‘দৈনিক আমার ইজতিমা’ ১৩ই জানুয়ারী ২০১৩ এর সৌজন্যে)   
খৃস্টান মিশনারিদের যে কোন লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের প্রধান সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় মুসলমানদের দুর্বল ঈমান। কাজেই ধর্মান্তর মোকাবেলায় এই দুর্বল ঈমানকে সবল করার কোন বিকল্প নেই। আর এই দুর্বল ঈমানকে সবল করার জন্য দাওয়াত ও তাবলীগের গুরুত্ব অপরিসীম। অতএব আমরা যদি দাওয়াত ও তাবলীগের এই মিশন অব্যাহত রাখি তাহলে ইনশাআল্লাহ ধর্মান্তরের এই কালো ছায়া অচিরেই বাংলার মাটি থেকে মুছে যাবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন