ঈমান কাকে বলে?

نحمده و نستعينه و نستغفره و نعوذ بالله من شرور أنفسنا و من سيئات أعمالنا, من يهده الله فلا مضلله و من يضلله فلا هادي له و نشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له و نشهد أن محمدا عبده و رسوله, و صلى الله عليه و على اله و أصحابه و سلم تسليما كثيرا كثيرا, 
أما بعد! فأعوذ بالله من الشيطان الرجيم, بسم الله الرحمن الرحيم: قد أفلح المؤمنون, الذين هم فى صلاتهم خاشعون... (سورة المؤمنون و قال النبي صلى الله عليه و سلم: لقد أُنْزِلَتْ علينا عشر
 آيات من أقامهن دخل الجنة ثم قرأ (قد أفلح المؤمنون) إلى عشر آيات- (جامع الترمذى

আল্লাহ তা’লার লাখো-কোটি শুকরিয়া যে, আল্লাহ তা’লা এই পবিত্র জুমআর দিনে আমাদেরকে দুনিয়ার হাজারো ব্যস্ততাকে ফাঁকি দিয়ে জুমার নামাজ পড়ার জন্য আল্লাহর ঘর মসজিদে আসার তৌফিক দান করেছেন এবং সেই সাথে দ্বীন ও ঈমান সম্পর্কে কিছু কথাবার্তা শোনার এবং বলার সুযোগ করে দিয়েছেন এই জন্য হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে আল্লাহর দরবারে একবার কৃতজ্ঞতা আদায় করি। বলি, আলহামদুল্লিাহ। কুরআনে কারিমের সূরা ইাবরাহীমে এরশাদ হয়েছে, 
لَئِن شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ ۖ وَلَئِن كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ (৭
অর্থঃ আমার কোন নিয়ামত পাওয়ার পর যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় করো তাহলে আমি আল্লাহ তা অবশ্যই তেমাদের জন্য বহুগুণে বাড়িয়ে দিবো। আর যদি সেই নিয়ামতের নাশুকরিয়া করো, নিয়ামত পাওয়ার পরও নাফরমানি করো তাহলে জেনে রেখো, আমার শাস্তি বড় যন্ত্রণাদায়ক। (সূরা ইবরাহীম-৭)

আমরা আমাদের জীবনে আল্লাহর তা’লার দেয়া হাজারো নিয়ামত ভোগ করি। মাথা থেকে পা পর্যন্ত, ব্যক্তি জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় জীবন সর্বত্র আল্লাহ তা’লা আমাদের অসংখ্য নিয়ামত দিয়ে রেখেছেন।  কুরআনে কারীমের সূরা নাবায় আল্লাহ তা’লা বান্দাকে দেয়া বড় বড় কয়েকটি নেয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ করেছেন, আমি কি জমীনকে তোমাদের জন্য বিছিয়ে দেই নি।  এবং পাহাড়কে জমীনের কীলক হিসেবে সৃষ্টি করিনি। এবং তোমদেরকে সৃষ্টি করেছি জোড়ায় জোড়ায়। এবং ঘুমকে তোমাদের জন্য করেছি প্রশান্তি দায়ক। এবং রাতকে করেছি তোমাদের জন্য বিশ্রামের সময়। এবং দিনকে করেছি তোমাদের জীবীকা নির্বাহের সময়। তোমাদের উপর সাত আসমানকে করেছি মজবুত ছাদ স্বরূপ। এবং সূর্যকে বানিয়েছি উজ্জল প্রদীপের ন্যয়। এবং ঘনকালো মেঘরাশি থেকে তোমাদের জন্য বৃষ্টি অবতীর্ণ করি। এই বৃষ্টির পানি দিয়েই জমিন থেকে তোমাদের জন্য শস্য উতপন্ন করি। এমন কোরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ তা’লা মানুষের উপর তার নেয়ামতের কথা বর্ণনা করেছেন। (সূরা নাবা: ৬-১৬)

পৃথিবীতে আমরা যত নেয়ামত ভোগ করি তার মধ্যে বান্দার জন্য সর্বাপেক্ষা এবং সবচেয়ে বড় নেয়ামত হল ঈমানের নেয়ামত। আল্লাহ তা’লা যাদেরকে ঈমানের দৌলত দান করেছেন, যারা ঈমান আনতে পেরেছে তারাই হল পৃথিবীতে সবচেয়ে মর্যাদাবান। আর যাদের পৃথিবীতে সব আছে, বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, সম্পদ আছে, ক্ষমতা আছে, মান-মর্যদা সব আছে কিন্তু ঈমান নেই পৃথিবীতে তার চেয়ে বড় হতভাগা, বড় মিসকীন আর কেউ নেই। কোরআনে আল্লাহ এরশাদ করেছেন, 
{ فمن يكفر بالطاغوت ويؤمن بالله فقد استمسك بالعروة الوثقى... }
অর্থ- যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনল, আল্লাহকে প্রতিপালক এবং একমাত্র উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করল সে যেন মজবুত রশিকে আঁকড়ে ধরল, যেই রশিকে ছিন্ন করার মত কোন শক্তি পৃথিবীতে নেই। (সূরা বাকারা-২৫৬)  
কোরআনের অন্যত্র এরশাদ হয়েছে,
  من يشرك بالله فقد حرم الله عليه الجنة ومأواه النار وما للظالمين من أنصار 
অর্থ- যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবেনা বরং আল্লাহর সাথে শরীক করবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিবেন আর জাহান্নামই হবে তার চিরস্থায়ী ঠিকানা। (সূরা মায়িদা-৭২)

কোরআনের সূরা মুমিনের প্রথম আয়াতে আল্লাহ তা’লা ঘোষণা করেন, 
قد أفلح المؤمنون, الذين هم فى صلاتهم خاشعون
অর্থ- নিশ্চয় মুমিনরাই সফলকাম। যারা তাদের নামাযে খুশু-খুযু অবলম্বনকারী। (সূরা মুমিনূন-১) 
এই আয়াতের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে বিশিষ্ট সাহাবী এবং খলিফাতুল মুসলিমীন হযর উমর ইবনুল খাত্তাব রা. এক হাদীসে বলেন, হাদিসটি ইমাম তিরমিযী রহ. তার সুনানে তিরমিযীতে বর্ণনা করেন,  উমর রা. বলেন,  একবার আমরা রাসূল সা. দরবারে বসা ছিলাম। এমন সময় হযরত জিবরীল আ. ওহী নিয়ে আসলেন। বুখারী শরীফের এক হাদীসে আছে, যখন আল্লাহর রাসূলের উপর অহী নাযিল হত  তখন তার চারপাশে ঘণ্টার মত টুনটুন আওয়াজ হত। এই আওয়াজ শুনে নবীজী বুঝতেন যে অহী নাযিল হবে। তো নবীজী এই আওয়াজ শুনে চুপ হয়ে গেলেন, উমর রা. বলেন, আমরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। হঠাত নবী সা. কিবলামুখী হলেন এবং দুই হাত উপরে তুলে বলতে লাগলেন,  
اللَّهُمَّ زِدْنَا وَلَا تَنْقُصْنَا، وَأَكْرِمْنَا وَلَا تُهِنَّا، وَأَعْطِنَا وَلَا تَحْرِمْنَا، وَآثِرْنَا وَلَا تُؤْثِرْ عَلَيْنَا، وَأرْضِنَا وَارْضَ عَنَّا
“হে আল্লাহ, আপনি আমাদেরকে বাড়িয়ে দিন, কমিয়ে দিয়েন না। আমাদেরকে সম্মানিত করুন, লাঞ্ছিত করবেন না। এবং আমাদেরকে দান করুন, বঞ্ছিত করবেন না। আপনি আমাদেরকে অন্যদের উপর প্রাধান্য দিন, আমাদের উপর অন্যদের প্রাধান্য দিবেন না। আপনি আমাদের উপর সন্তুষ্ট হোন, বিরূপ হয়েন না।” 
সাহাবয়ে কেরাম আল্লাহর রাসূলের এই অবস্থা দেখে আশ্চর্য হলেন। রাসূল সা. সাহাবায়ে কেরামকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কী জানতে চাও, জীবরীল আমার নিকট কী অহী নিয়ে এসেছে? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, অবশ্যই। আপনি আমাদেরকে বলুন। তখন আল্লাহর রাসূল সা. বললেন, 
لقد أُنْزِلَتْ علينا عشر آيات من أقامهن دخل الجنة ثم قرأ (قد أفلح المؤمنون) إلى عشر آيات-الترمذى)
অর্থ- এইমাত্র আমার উপর এমন  দশটি আয়াত নাযিল হয়েছে কেউ যদি এই দশটি আয়াতকে মজবুতভাকে আঁকড়ে ধরে এবং সেই অনুযায়ী আমল করে তাহলে সে সোজা জান্নাতে চলে যাবে। (সুনানে তিরমিযী-৩১৭৩)

আপনারা জানতে চান, সেই দশটি আয়াত কী? সেই দশটি আয়াত হল সূরা মুমিনূনের ১ম দশটি আয়াত।
এই দশটি আয়াতে আল্লাহ তা’লা সাতটি গুণের কথা উল্লেখ করেছেন। এবং বলেছেন, যারাই এই সাতটি গুণে গুণান্বিত হবে, যারাই এই সাতটি বৈশিষ্টকে নিজের জীবনে লালন করতে পারবে তারাই দুনিয়া ও আখেরাতে সফলকাম হবে। আল্লাহ তা’লা আমাদের সকলকে এই সাতটি গুণকে নিজের জীবনে ধারণ করার তৌফিক দান করুন এবং ইহকালে ও পরকালে চূড়ান্তরূপে সফলকাম করুন। 

এই সাতটি গুণ বা বৈশিষ্ট নিয়ে আলোচনা করলে অনেক দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। আজ শুধুমাত্র প্রথম যেই গুণটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা নিয়েই আলোচনা করবো। আল্লাহ তা’লা যদি ভবিষ্যতে আপনাদের মাঝে আবার কথা বলার সুযোগ করে দেন তাহলে ইনশাআল্লাহ বাকি বৈশিষ্টগুলো নিয়ে আলোচনা করবো। 

আয়াতে উল্লেখিত সাতটি গুণের মধ্যে সর্ব প্রথম আল্লাহ তা’লা যেই গুণটির কথা উল্লেখ করেছেন তা হল ‘ঈমান’। ইরশাদ করেছেন, ‘সফলকাম তারা যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে।’ 
ঈমান কাকে বলে?  বুখারী শরীফের কিতাবুল ঈমানের এক হাদীসে এসেছে, একবার সাহাবায়ে কেরামসহ নবি সা. এক মজলিসে বসা ছিলেন। এমন সময় জীবরীল আ. মানুষের বেশে আসলেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে দ্বীন শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে দ্বীন সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করলেন। তার মধ্যে প্রথম প্রশ্ন ছিল? ঈমান কাকে বলে? আল্লাহর রাসূল সা. উত্তর দিলেন, 
الإيمان أن تؤمن بالله وملائكته وكتبه وبلقائه ورسله وتؤمن بالبعث 
ঈমান হল, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা, এবং তার ফেরেশতাদের উপর ঈমান আনা, এবং আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের বিষয়ে ঈমান আনা, এবং যুগে যুগে প্রেরিত রাসূলগণের প্রতি ঈমান আনা, এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের উপর বিশ্বাস রাখা। (সহীহ বুখারী-৫০) 

সূরা বাকারায় আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন, 
آمنوا كما آمن الناس
অর্থ- তোমরা ঈমান আনো যেমন লোকেরা ঈমান এনেছে । (সূরা বাকারা-১৩)
মুফাসসিরীনে কেরামগণ বলেন, এই আয়াতে লোক বলে আল্লাহ তা’লা সাহবায়ে কেরামদেরকে বুঝিয়েছেন। অর্থাত, সাহাবায়ে কেরাম যেভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছেন, যে যে বিষয়ের উপর তারা ঈমান এনেছেন তোমরাও ঠিক সেভাবেই ঐ বিষয়গুলির প্রতি ঈমান আনো। 
মুহাদ্দীসীনে কেরামগণ বলেন, সাহাবায়ে কেরামের ঈমানের তিনটি অংশ ছিল। তাদের ঈমান ছিল তিনটি বিষয়ের সমষ্টি। তাদের এই তিনটি বিষয়কে একত্রে বলা হত ঈমান। 
একটি হল, إقرار باللسان তথা- মৌখিক স্বীকৃতি। অর্থাত, সর্ব প্রথম মুখে এই কথা স্বীকার করতে হবে যে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ এক, অদ্বিতীয়, তার কোন শরীক নেই। এবং মুহাম্মদ সা. তার রাসূল। 
দ্বিতীয়টি হল. تصديق بالجنان অন্তর দিয়ে সত্যায়ন করা। অর্থাত মন থেকে আল্লাহ ও তার রাসূলকে বিশ্বাস করা। 
তৃতীয়টি হল, عمل بالأركان শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে তা বাস্তবায়ন করা। অর্থাত, মুখ দিয়ে স্বীকার করার পর, হৃদয় থেকে বিশ্বাস করার পর ইসলামের বিধি-বিধানগুলোকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা। ঈমান হল এই তিন জিনিসের নাম।

হাদীস শরীফে এসেছে, 
من قال: لا إله إلا الله دخل الجنة
যে ব্যক্তি মুখে বলবে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এই হাদীসে মৌখিক স্বীকৃতির কথা বলা হয়েছে। অর্থাত মুখে বলতে হবে,  আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। 
কেউ শুধু  মুখে স্বীকার করল, যে আমি ঈমানদার কিন্তু হৃদয় দিয়ে সে বিশ্বাস করল না তাহলেও সে মুমিন হবে না। যারা শুধু মুখে বলে আমরা ঈমানদার কিন্তু অন্তরে পোষণ করে অবিশ্বাস আর নাস্তিকতা তাদেরকে কোরআনের ভাষায় বলা হয় মুনাফিক। এই মুনাফিকদের চরিত্র কোরআনের সূরা বাকারায় আল্লাহ তা’লা এভাবে বর্ণনা করেন যে, আর তারা যখন ঈমানদার লোকদের মুখোমুখী হয় তখন মুখে বলে, আমরা ঈমান এনেছি কিন্তু যখন শয়তান মুশরিকদের সাথে সাক্ষাত হয়, বেদ্বীন, নাস্তিকদের সাথে দেখা হয়, তখন বলে আমরা তো তোমাদের সাথেই আছি, ওদের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রপ‌ করছিলাম। এরাই হল ঐসকল লোক, যারা শুধুমাত্র মুখে স্বীকার করেছে আমরা ঈমান এনেছি, কিন্তু ঈমানের বাকি দুটি অংশ; অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করা ও সে অনুযায়ী আমল করা এগুলো তারা করেনি। এদের শাস্তির ব্যপারে কোরআনের সূরা নিসায় আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন, নিশ্চয়, মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনি স্তরে থাকবে।    

(খেতাবতির জন্য ইন্টারভিউ বয়ান)
-৩ এপ্রিল ২০১৫, শুক্রবার
আল হেরা জামে মসজিদ 
জিগাতলা, ধানমন্ডি, ঢাকা

1 টি মন্তব্য:

M Nojrul বলেছেন...

জাযাকাল্লাহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন