নানু এল লাঠি হাতে, পালাই! পালাই!


শৈশবের অধিকাংশ স্মৃতি যেখানটা ঘিরে লতিয়ে উঠেছে তা হল আমার নানু বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে নানু বাড়ি -নে- দূর চারশত কিলোমিটার তাই নানু বাড়ি যাওয়ার সুযোগও আসত বহুদিন পর পর আর যখন যাওয়া হত তখন মাস ছয়েক না থেকে আসার সুযোগ ছিল না ফলে এত দীর্ঘ সময় নানু বাড়িতে থাকার কারণে নানু বাড়ির সাথে আমার সখ্যতা ছিল ঈর্ষণীয় পর্যায়ের মামাতো ভাইবোনদের সাথে এমনভাবে মিশে যেতাম যে ওটাকে আর নানু বাড়ি মনে হত না, নিজের বাড়িই জ্ঞান করতাম তাই সে সময়ের কাণ্ড-কারখানা যেগুলো ঘটাতাম সেগুলোও নিজ বাড়ির দস্যিপনার চেয়ে কম ছিল না

সেই নানু বাড়ির দুরন্তপনার একটা স্মৃতি আজও করোটির ভিতর তোলপাড় করে তখন ছিল জৈষ্ঠের খরতাপ আম, কাঠাল, জাম, লিচু পাকার মোক্ষম সময় বটে আর সে সময়টাতে আমার মত 'বদের হাড্ডি' নানু বাড়িতে
বনেদি পরিবার হওয়ায় নানু বাড়িতে আম, জাম, কাঠালের কোন কিছুরই অভাব ছিল না কিন্তু কথায় আছে না, বাড়ির গরু বাড়ির ঘাস খায় না আমরাও তাই নিজেদের গাছভর্তি আম-কাঠাল রেখে চলে যেতাম অন্যের আমতলায়, অমুক বাড়ির কাঠালতলায় আর পশ্চিম পাড়ার জাম তলাটায় এরপর ঝোঁপ বুঝেই কোপ দিতাম

এটা শৈশবের দস্যিপনা বৈ কিছু নয় এমনটা ভাববার কোন কারণ নেই যে, আমি বুঝি, ছোটকালে খুব দুরন্ত আর দস্যি ছিলাম মোটেও নয়  আমি এখনের মতই হাবাগোবা টাইপের 'শান্ত শিষ্ট লেজ বিশিষ্ট' নিরীহ প্রকৃতির প্রাণীই ছিলাম! তবে এসকল দস্যিপনায় আমাকে যে 'রাহবারি' করত সে হল শৈশবের খেলার সাথী নোমান দুরন্তপনায় আমি ছিলাম তার বাধ্যগত একান্ত শিস্য ফলে নানু বাড়িতে আমার আগমন টের পেলে সেই বোধহয় সবচে' বেশি খুশি হত

..............সেদিনের দস্যিপনায় সেই ছিল আমাদের লিডার আমরা ছিলাম চারজন আমি, নোমান, মামাতো বোন হুমায়রা, রাজিয়া আমরা সবাই তখন আট কি নয় বছর অতিক্রম করছি খবরটা প্রথমে নোমানই সরবরাহ করেছিল পশ্চিম পাড়ার অমুক গাছের একটা কাঠাল পেকেছে দু'দিন হল সে কি ঘ্রাণ!! যাক দস্যিপনার একটা মোক্ষম সুযোগ!!

এরপর ঘণ্টা দুয়েক মেহনত-মোজাহাদা বহু কায়িক কসরতের পর পশ্চিম পাড়ার গাছ পাকা কাঠালটা 'চৌর্যবৃত্তির' মাধ্যমে আমাদের হস্তগত হল কিন্তু বিপত্তি দেখা দিল, এটাকে সাবাড় করবো কোথায় বসে!? চোরের মন তো পুলিশ পুলিশ! যদি ধরা খেয়ে যাই! তারপর সবাই মিলে 'মশওয়ারা' সাপেক্ষে নানু বাড়ির পূবের পরিত্যক্ত ঘরটাকে নিরাপদ ঠাহর করে ওখানেই সবাই গোল হয়ে বসলাম আলো আসার জন্য ঘরের কপাটটা ঈষৎ খোলা রেখেই বিসমিল্লাহ বলে আমাদের কাঠালের কোষ বিসর্জন শুরু হল ঘরে ঢুকার আগেই এক পলক দেখে এসেছি, নানু ঘুমুচ্ছে এই অসময়ে আর কেউ বাড়িতে নেই তাই আমাদের এহেন আপকর্মে কেউ নাক গলাবে এমন কোন আদমি তখন বাড়িতে ছিল না আমরাও তাই অধিক নিরাপদ ভেবেই নীচু স্বরে গল্পে গল্পে কাঠলের কোষ উদরস্থ পাকযন্ত্রের কাছে পাচার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম

কোন কারণ ছাড়াই দরজার দিকে দৃষ্টি গেল আমার ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম লাঠি হাতে নানু দরজায় স্বমূর্তিতে দণ্ডায়মান! আমার হাতের কাঠালের কোষটা অর্ধেক মুখে অর্ধেক বাহিরে স্থবির যেন! নোমান বলল, 'কিরে কী হয়েছে তোর? কাঠালের কোষ মুখে নিয়ে আবুলের মত অমন কী দেখছিস?' দরজার দিকে চোখ দিয়ে ইশারা করলাম পেছন ফিরতেই সবার চক্ষু চরক গাছ! দৌড় দিবো নাকি মাথা পেতে সুবোধ বালকের মত বেত্রাঘাত খাবো, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না কেউ

এসময়ই হঠাৎ করে মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি এল নানিকে ভেতরে ঢুকতে দেখে "নানি এল লাঠি হাতে, পালাই! পালাই!!"- রব তুলে দিলাম ভোঁ দৌড় ওরাও এমন দুষ্ট! আমার সাথে সাথে একই ছন্দ তুলে ওরাও ভোঁ দৌড়! এবার সবাই মিলে সমস্বরে সুর করে গাইছি- "নানি এল লাঠি হাতে, পালাই! পালাই!" আর দৌড়ছি হাতে কাঠালের কষ, মুখে কাঠালের কোষ, গলায় ব্যঙ্গাত্মক আবৃত্তি আর নানির সাথে চলছে ম্যরাথন দৌড় প্রতিযোগিতা দেখার মত দৃশ্য বটে! নানু আমাদের বাঁদরামি দেখে হাসবেন, না দৌড়বেন.....!!!

এখনো নানু বাড়ি গেলে নোমানের সাথে দেখা হলে নিয়ে বিস্তর হাসাহাসি হয় কিন্তু বাড়ির খোলেনের শেষ মাথায় নানুর কবরর দিকে যখন অকষ্মাৎ দৃষ্টি চলে যায় তখন সব হাসি-আনন্দ নিমিষেই চুপষে যায় ভিতরটা হাহাকার করে উঠে বাড়ি ভর্তি মানুষ! উঠোন ভর্তি মানুষ!! তারপরও একটা প্রবল শূন্যতা অনুভব করি

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন