আল্লাহ
তা’লা পৃথিবীতে যত মহামানব পাঠিয়েছেন তন্মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বাধিক কল্যাণকামী
মানুষ হচ্ছেন প্রেরিত নবী-রাসূলগণ। মানবতার মুক্তির দূত, নবীকুল শিরোমণি,
রাহমাতুল্লিল আলামীন হযরত মুহাম্মদ সা. ছিলেন তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ আসনে সমাসীন।
মহানবী সা. এর জীবনাদর্শ হল কালোত্তীর্ণ শাশ্বত ও সর্বোত্তম জীবন ব্যবস্থা। পরিবার, সমাজ,
রাষ্ট্র, পারিবারিক জীবন পদ্ধতি, সামাজিক জীবন ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক লেনদেন,
রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড সবক্ষেত্রেই মহানবীর পদচারণা ছিল অনুকরণীয়। তাই মহানবী সা.
হচ্ছেন বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী। তার জীবনের প্রতিটি পর্যায় মানবতার জন্য
আলোকবর্তিকা। জন্ম থেকে শৈশবকাল, বালক থেকে যুবক জীবনের যে কোন মঞ্জিলে তিনি ছিলেন
আদর্শের ধারক-বাহক। শুধু নবুওয়াতী যিন্দেগীই নয়, নবুয়তপূর্ব জীবনেও রাসূল সা.
আদর্শের যে নমুনা রেখে গেছেন তা পৃথিবীর অনাদিকালের মানুষের জন্য অদ্বতীয় আলোর উতস
হয়ে থাকবে চিরকাল।
মহানবী হযরত
মুহাম্মদ সা. এর শৈশবকালও ছিল এমনই এক আদর্শময় জীবন। যুগ যুগ ধরে আরবের রীতি ছিল
স্বীয় নবজাতককে জন্মের পর শহরের নিকটবর্তী গোত্রের কোন দুগ্ধমাতার নিকট অর্পণ করা।
এর ফলে একদিকে মুক্ত প্রান্তরের মুক্ত আবহাওয়ায় লালিত-পালিত হবে , অপরদিকে
শুদ্ধ ও প্রাঞ্জল আরবী ভাষায় কথা বলা শিখবে, যা তদানীন্তন সময়ের আরবের প্রধান আকর্ষণ
ছিল।
এছাড়াও
যেহেতু সন্তানকে পান করানোর জন্যে মা আমিনার দুধ ছিল না সেহেতু হযরত মুহাম্মদ
(সা.)-এর পিতামহ ও অভিবাবক আবদুল মুত্তালিব তাঁর পুত্র আবদুল্লাহর স্মৃতিচিহ্ন
প্রিয় হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সেবা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে কোন পবিত্র ও সম্মানিতা
নারীর অনুসন্ধান করলেন। যথেষ্ট অনুসন্ধানের পর বনি সা’ দ গোত্রের হালিমার সন্ধান পাওয়া গেল , যিনি পবিত্র
ও সম্ভ্রান্ত বলে পরিগণিত ছিলেন। অবশেষে তাকেই মহানবীর রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে
নির্বাচন করা হলো। হালিমা
ছিলেন বনু সা'দ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। তার স্বামীর নাম ছিলো হারেস ইবনে
আবদুল ওযযা। মুহাম্মাদ সা. নবুয়্যত লাভের পর তিনি মক্কায় এসে ইসলাম গ্রহণ করেন।
হালিমা রা. এর এক পুত্র এবং তিন কন্যা সন্তান ছিল। পুত্রের নাম ছিল আবদুল্লাহ। আর কন্যা
তিনজনের নাম ছিল আনিসা, হোযায়ফা এবং শায়মা। এদের মাঝে আবদুল্লাহ্ এবং শায়মার ইসলাম গ্রহণের কথা জানা
যায়। বাকীদের ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি অজ্ঞাত।
মুহাম্মদ (সাঃ) এতিম বিধায় প্রথমে কোন নারী তাকে দুধ
খাওয়ানোর জন্য নিতে চায়নি। কিন্তু হালিমা অন্য কোন শিশু সন্তান না পাওয়ায় এই
এতিম শিশুটিকেই গ্রহণ করেন।
আর এরপরই হযরত হালিমার পরিবারে শুরু হয় প্রাচুর্য আর বরকতের
সব অলৌকক ঘটনাবলী। এ সম্পর্কে হযরত হালিমা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, "আমরা যখন
শিশুর খোজে মক্কায় গিয়েছিলাম তখন আমাদের বাহন ছিল দুর্বল, পথ চলতে পারত না। কিন্তু
মক্কা থেকে ফেরার পথে শিশু মুহাম্মদ (সা.)-কে কোলে নিয়ে যখন দুর্বল বাহনটিতে চলতে
লাগলাম, মুহাম্মদ
(সা.)-এর বরকতে বাহনটি এত দ্রুত চলল যে, সবার বাহনকেই হার মানাল।” আমার সাথী
মহিলারা আশ্চর্য হয়ে বলতে লাগল এটা কি সেই দুর্বল সাওয়ারী যার ওপর আরোহণ করে তোমরা
প্রথম এসেছিলে?
বনি সা’ দ গোত্র দীর্ঘ দিন যাবৎ দুর্ভিক্ষে
ভুগছিল। অপরদিকে শুষ্ক প্রান্তর ও মেঘহীন আকাশ তাদের দুর্দশা ও দারিদ্রের মাত্রা
বৃদ্ধির কারণ হয়েছিল। কিন্তু যেদিন থেকে মহানবী (সা.) হালিমার গৃহে পদ ধুলি দিলেন, তার সার্বিক
উন্নতি ও বরকত পরিলক্ষিত হল এবং অভাব অনটনের মধ্যে যার জীবন কাটত তার জীবনে সমৃদ্ধি
দেখা দিল।
হালিমা রা.
বলেন, শিশু মুহাম্মদ (সা.)-কে আমার গৃহে আনার সাথে সাথেই রহমত বরকত প্রকাশ হতে
লাগল। বাড়ী এসে দেখলাম,
সমস্ত বকরীগুলো দুধে পূর্ণ হয়ে আছে। অথচ কিছুক্ষণ পূর্বে সেগুলো দুধ শূন্য
ছিল। আমার স্বামী উটনীর দুধ দোহন করলেন। এতো পরিমাণ দুধ
নির্গত হলো যে,
শিশু মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর দুধ ভাই একান্ত তৃপ্তির সাথেই দুধ পান করে ঘুমিয়ে পড়ল। এবং
আমরাও তৃপ্তির সাথে তা পান করে সারারাত আরামে কাটালাম। আর উটনীর
দিকে চেয়ে দেখতে পাই,
সেগুলোর স্তন আবার দুধে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে।
বিবি হালিমা
বলেন, দীর্ঘদিন
পর এটাই ছিল প্রথম রাত্রি,
যেদিন আমরা শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম।” আমার স্বামী বললেন, ”হালিমা!
তুমি খুবই ভাগ্যবান শিশু নিয়ে এসেছ।” আমি বললাম, আমারও এটাই
ধারণা, এই
শিশু অত্যন্ত সৌভাগ্যবান।
আমাদের
পশুদের এই অবস্থা দেখে আমার গোত্রের লোকেরা তাদের রাখালদের নির্দেশ দিল যে, তোমরাও
তোমাদের পশু ঐ জায়গায় চরাও যেখানে হালিমার বকরী চরে, কিন্তু তা তো চারণভূমির বিশেষত্ব ছিল না। বরং বরং শিশু মুহাম্মদের বরকত
এর মধ্যে নিহিত ছিল,
তা ঐ সমস্ত লোক কোথায় পাবে। এভাবে আমরা প্রায়ই, তাঁর বরকতের ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ
করতাম।
শিশু নবী হযরত
মুহাম্মদ (সা.) শৈশবের একটি ঘটনা অত্যন্ত বিষ্ময়কর এবং মানবতার জন্য শিক্ষণীয়। তিনি
কখনও হালিমা রা. এর উভয় স্তন থেকে দুধ পান করতেন না। সব
সময় একটি স্তন থেকেই দুধ পান করতেন। অপরটি তাঁর দুধভাই আব্দুল্লাহর জন্য রেখে
দিতেন। ন্যায়বোধে ও ইনসাফ কায়েমের এমন উত্তম দৃষ্টান্ত তিনি শৈশবেই মানুষের সামনে
উপস্থাপন করেছেন। সত্যই এটা একজন মহামানবের পক্ষেই সম্ভব।
হযরত হালিমা
বর্ণনা করেছেন, তিনি
কখনও শিশু মুহাম্মদ (সা.)-কে উলঙ্গ অবস্থায় রাখতে পারতেন না। এরূপ করলেই তিনি
চিৎকার করে কাটাতেন,
যতক্ষণ পর্যন্ত তার শরীরের উপর চাদর টেনে দেয়া না হতো ততক্ষণ তিনি ক্রন্দন
থামাতেন না। হালিমা বলেন,
যেদিন থেকে আমি জানতে পারলাম, শিশু মুহাম্মদ (সা.) উলঙ্গ থাকতে পছন্দ করেন না, সেদিন থেকে
আর কখনও তাঁকে উলঙ্গ রাখিনি। তাঁর দেহ আবৃত করে রাখার জন্য সর্বদা সজাগ দৃষ্টি
রাখতাম।
সারোয়ারে
কায়েনাত দোজাহানের সম্রাট রাসূল (সা.) অতি শৈশবকাল থেকেই একান্তভাবে পাক সাফ
থাকতেন। শিশুরা সাধারণত নিজের পায়খানা প্রস্রাব নিজের অঙ্গে প্রত্যঙ্গে বা জামা
কাপড়ে মেখে থাকে, এমনকি
তা মুখে দিয়ে থাকে। রাসূল (সা.)-এর দুধমাতা হালিমা (রাঃ) বর্ণনা করেন, ”শিশু
মুহাম্মদ (সা.) কখনও বিছানায় পেশাব পায়খানা করে নিজ অঙ্গ বা কাপড় অপবিত্র করেননি।
তাঁকে বিছানা থেকে উঠিয়ে দু’পায়ের উপর দাঁড় করান ব্যতীত কখনও পায়খনা পেশাব করতেন না।
সাথে সাথে তাঁকে পরিষ্কার করে দিতাম। তিনি যে আল্লাহ্ তায়ালার সৃষ্ট নূরের তৈরি
মানুষ তাতে আমার কোন সন্দেহ ছিল না। সুতরাং সর্বাবস্থায় পাক সাফ থাকা তাঁর পক্ষে
অস্বাভাবিক কিছু নয়।
দুই বছর লালনপালনের পর হালিমা শিশু মোহাম্মদকে আমিনার কাছে
ফিরিয়ে দেন। কিন্তু এর পরপরই মক্কায় মহামারী দেখা দেয় এবং শিশু মুহাম্মদকে
হালিমার কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। হালিমাও চাচ্ছিলেন শিশুটিকে ফিরে পেতে। এতে তার
আশা পূর্ণ হল।
এর কয়েকদিন পরই ঘটে একটি অলৌকিক ঘটনা- বিশ্বস্ত হাদিস
গ্রন্থ মুসলিম শরীফের বর্ণনামতে, একদিন শিশু নবীর বুক চিরে কলিজার একটি অংশ বের
করে তা জমজম
কূপের পানিতে ধুয়ে আবার যথাস্থানে স্থাপন করে
দেয়া হয়। এর মাধ্যমে মুহাম্মদ সা. এর দেহ থেকে অপবিত্র সব কিছু ধুয়ে ফেলা
হয়েছিল। ইবনে
খালদুনের বর্ণনামতে, তার অন্তরে নূর ভরে দেয়া
হয়। এই ঘটনাটি সিনা চাকের ঘটনা হিসেবে খ্যাত।
এই অলৌকিক ঘটনার পরই হালিমা রা. মুহাম্মদ সা. কে মা আমিনার
কাছে ফিরিয়ে দেন। ছয় বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তিনি মায়ের সাথে কাটান। এই
সময় একদিন আমিনার ইচ্ছা হয় ছেলেকে নিয়ে মদীনায় যাবেন। আত্মীয়ের সাথে দেখা করা
এবং স্বামীর কবর জিয়ারত করাই এর কারণ ছিল। মা আমিনা ছেলে,
শ্বশুর এবং দাসী উম্মে আয়মানকে নিয়ে ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মদীনায় পৌঁছেন। তিনি
মদীনায় একমাস সময় অতিবাহিত করেন। একমাস পর মক্কায় ফেরার পথে আরওয়া নামক স্থানে এসে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই
মৃত্যুবরণ করেন।
আর এ ভাবেই
মুহাম্মদ (সা.) তাঁর শৈশবেই যখন পিতার অপরিসীম স্নেহ আর মায়ের দয়ার্দ্র আঁচলের
প্রয়োজন ছিল, যা
প্রতিটি শিশুর জন্যেই জরুরি , তা হারালেন।
মুফতি মাহমুদ হাসান
ইমাম ও খতীব
আল-হেরা জামে মসজিদ
জিগাতলা, ধানমন্ডি, ঢাকা
৫টি মন্তব্য:
খুব সুন্দর লিখা অনেক কিছু জানলাম
এত কাহিনি কখনো শুনেনি খুব সুন্দর
nice
হযরত মুহাম্মদ স. জীবন খুব সুন্দর করে উপস্থাপন করা হয়েছে। ধন্যবাদ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন