দাওয়াত ও তাবলীগ : মুক্তির শ্বাশ্বত পয়গাম

‘যত জন তত মত’। কথাটা শতভাগ সত্য। প্রতিটি বিষয়ে প্রতিটি মানুষের মত ও পথের ভিন্নতা অনস্বীকার্য। কিন্তু কিছু বিষয়  এমনও আছে যেগুলোতে মানুষের কোন মত ভিন্নতা নেই। আস্তিক-নাস্তিক, ধনী-গরীব, কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ সকলেই একমত পোষণ করে। তার একটি হল: পার্থিব সুখ-শান্তি। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই চায় একটু সুখে থাকতে, শান্তিতে দিন গুযরান করতে। জীবনের এত কোলাহল, জগতের এত কষ্ট-সাধনা সব কিছুই মূলত সামান্য সুখ আর একটু শান্তিতে বসবাসের নিমিত্তে। কিন্তু কোথায় সেই সুখ? কোথায় সেই শান্তি? পৃথিবীর সবকটি মানুষ হন্যে হয়ে ছুটছে জীবনের অনাবিল সেই সুখ আর শান্তির সন্ধানে। কিন্তু কোত্থাও দেখা মিলছে না তার।

কারণ, মানুষ সুখ খোঁজে পার্থিব উন্নতি আর সমৃদ্ধির মাঝে। শান্তি খোঁজে জাগতিক ভোগ-বিলাসিতার মাঝে। অথচ কাড়ি কাড়ি টাকা, আলীশান বাড়ি-গাড়ি আর পার্থিব অঢেল প্রাচুর্যের মাঝে কোন সুখ নেই, শান্তি নেই। কেননা এই সুবিশাল মহাবিশ্বের যিনি ¯্রষ্টা, প্রতিটি অনু-পরমাণু যার সৃষ্টি তিনিই তো জানেন কিসে তার সৃষ্ট মানব সমাজের সুখ-শান্তি। তিনিই তো এসব কিছুর মাঝে সুখ-শান্তি রাখেননি। সকল সুখ আর শান্তি তিনি রেখেছেন তাঁর সামনে মাথা ঝোঁকানোর মধ্যে। দুনিয়ার লোভ-লালসা, পার্থিব মোহ-মায়া বিসর্জন দিয়ে তাঁর পথে ফিরে আসার মধ্যেই নিহিত আছে মানবতার সুখ-শান্তি, কল্যাণ ও মুক্তি। 

সুখ-শান্তি, কল্যাণ ও মুক্তির এই পয়গাম মানুষের কাছে পৌঁছে 
দেয়ার জন্যই যুগে যুগে আল্লাহ তা’লা লক্ষাধিক নবী-রাসূলকে এই পৃথিবীতে প্রেরণ করেছিলেন। তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্যই ছিল মানুষকে শান্তি ও কল্যাণের পথের সন্ধান দেয়া, দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতার পয়গাম পৌঁছে দেয়া। কুরআনে কারিমে এরশাদ হয়েছে- ‘আর আমি প্রত্যেক জাতির মাঝেই একজন করে রাসূল পাঠিয়েছি এই বার্তা নিয়ে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, এবং তাগুতকে পরিত্যাগত কর। (সূরা নাহল-৩৬)। 

সর্বশেষে এই দাওয়াত ও পয়গাম নিয়ে যিনি এই পৃথিবীতে আগমন করেছেন তিনি হলেন আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সা.। দীর্ঘ তেষট্টি বছর মানুষকে তিনি শুনিয়েছেন সত্যের পয়গাম ও মুক্তির দিশা। পলে পলে মানুষকে ডেকেছেন আল্লাহর পথে, সুখ ও শান্তির পথে। শুধু পার্থিব জগতে নয়, বরং মৃত্যুর পরের জগতেও কিভাবে মানব জাতির সুখ ও শান্তি মিলবে সেই বার্তা তিনি পৌঁছে দিয়েছেন সমগ্র মানব জাতির কাছে। তাঁর এই শ্বাশ্বত আহ্বান সম্পর্কে আল্লাহ তা’লা ঘোষণা করছেন- ‘হে রাসূল! আপনি বলুন, এটাই হল আমার পথ। বুঝে-শুনে এই পথেই আমি মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করি, এবং যারা আমাকে অনুসরণ করে তারাও।’ (সূরা ইউসূফ-১০৮)। অর্থাৎ আমি বিশ্ব মানবতাকে আহ্বান করি যে, সমস্ত ধ্যান-ধারণা, মত ও পথ ছেড়ে এক আল্লাহর অভিমুখী হও। আমার এই পথই হল চির শান্তি ও সুখের পথ।

আল্লাহ রাসূলের ইনতেকালের পর এই পয়গাম মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া, পথভ্রান্ত এই মানবতাকে সঠিক পথের দিশা দেয়া তাঁর অুনসারীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এই দায়িত্বের ব্যপারে সূরা আল-ইমরানে আল্লাহ তা’লা বলেন- ‘তোমাদের মধ্যে অবশ্যই একটি জাতি এমন থাকবে, যারা মানুষকে কল্যাণের পথে আহ্বান করবে। এবং ভালো কাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে।’ (আল ইমরান-১০৪)। রাসূলের পর থেকে আজ পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহ এই গুরু দায়িত্বকে আঞ্জাম দেয়ার জন্য বিশ্বব্যপী কাজ করে যাচ্ছেন।

দাওয়া’র পথ ও পদ্ধতিঃ

কুরআনে কারীমের সূরা বাকারায় এরশাদ হয়েছে- ‘হে আমাদের প্রভু! তাদের মাঝে একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যিনি তাদেরকে আপনার কিতাবের আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করে শুনাবেন, এবং আপনার কিতাবের জ্ঞান তাদেরকে শিক্ষা দিবেন, এবং শিক্ষা দিবেন হিকমত ও প্রজ্ঞা, এবং তাদের আত্মশুদ্ধি করবেন।’ (সূরা বাকারা-১২৯)। এই আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে, রাসূলের মৌলিক দায়িত্ব ছিল চারটি- 
১. মানুষকে কুরআনের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত শিক্ষা দেয়া। 
২. কুরআনের তাফসীর, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শিক্ষা দেয়া। 
৩. হিকমত তথা সুন্নাহর জ্ঞান শিক্ষা দেয়া। 
৪. মানুষের আত্বশুদ্ধি করা। 
নবুওয়াতি যিন্দেগীর তেইশ বছরে রাসূল সা. মৌলিকভাবে এই চারটি দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন। আল্লাহর রাসূলের এই চারটি কাজ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বকেই বলা হয় ‘দাওয়াত ও তাবলীগ’। রাসূলের পর মুসলিম উম্মাহ যুগে যুগে দাওয়াত ও তাবলীগের এই মহান কাজ করে আসছেন বিভিন্ন পন্থায়। মাদরাসা-মসজিদ, মারকায-খানকাহ, ওয়াজ-নসীহত, বই-পুস্তক ইত্যাদির মাধ্যমে আজও এই দাওয়াতি মিশন চলছে। সুতরাং যারা মক্তবে ছোট ছোট শিশুকে কুরআন শেখাচ্ছেন তারা যেমন দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ আঞ্জাম দিচ্ছেন, তেমনি যারা মাদরাসা-মসজিদে মানুষের কাছে কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান পৌঁছে দিচ্ছেন তারাও মূলত দাওয়াত ও তাবলীগের কাজই আঞ্জাম দিচ্ছেন। আবার যারা আত্মশুদ্ধির পদ্ধতি অনুসরণ করছেন কিংবা তিনদিন-চল্লিশদিনের জন্য দ্বারে দ্বারে গিয়ে আল্লাহ ভোলা মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকছেন তারাও মূলত রাসূলের এই দায়িত্বের তাবলীগই করছেন। পথ ও পন্থা ভিন্ন হলেও প্রত্যেক দলই মূলত একে অপরের সম্পূরক ও পরিপূরক, প্রতিপক্ষ বা ভিন্নমতাবলম্বী নয়। সকলেই মূলত একই গন্তব্যের দিকে ভিন্ন ভিন্ন পথের অভিযাত্রী। পথ ও পদ্ধতির এই ভিন্নতাকে স্বয়ং আল্লাহ তা’লাই কুরআনে কারিমে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এরশাদ করেছেন- ‘আর যারা আমার দিকে আসার জন্য চেষ্টা-সাধনা করে আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার দিকে আসার বিভিন্ন পথের সন্ধান দিয়ে থাকি।’ (সূরা আনকাবূত-৬৯)। এই আয়াতে আল্লাহ তা’লা নিজেই বলেছেন যে, তাঁর দিকে যাওয়ার পথ বিভিন্ন। তাই গন্তব্য অভিন্ন হলে পথ ও পদ্ধতির ভিন্নতা ইসলামে নিষেধ নয়, বরং যুগের বিবর্তনে, নিত্য নতুন প্রেক্ষাপটে তা আবশ্যকীয়ও বটে।

দাঈ’র বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলীঃ

যারা মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করবে, যারা রাসূলের শ্বাশ্বত পয়গামকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিবে তাদের পথ ও পদ্ধতি ভিন্ন হলেও তাদের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী অবশ্যই অভিন্ন হবে। আল্লাহর রাসূল সা. যে সকল বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী নিয়ে মানুষকে আল্লাহর পথে ডেকেছেন সেই বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী প্রত্যেক দাঈ’র মাঝে থাকতে হবে। এক্ষেত্রে রাসূলের সবচে’ বড় যে বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় তা হল- নম্রতা ও বিনয়। এ ব্যপারে কুরআনে কারীমে এরশাদ হয়েছে- ‘আল্লাহর অনুগ্রহের কারণেই আপনি মানুষের প্রতি সদয় হয়েছেন। আর আপনি যদি রাগী মেজায এবং পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী হতেন তাহলে আপনার চারপাশের মানুষগুলো আপনার দিকে ছুটে আসত না।’ (সূরা আল ইমরান-১৫৯)। সাহাবায়ে কেরামের এই বিশাল জামাত রাসূলের চারপাশে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় একত্রিত হওয়ার মূল কারণ ছিল রাসূলের সদয় ও বিনম্র আচার-ব্যবহার। তাই একজন ‘দাঈ ইলাল্লাহ’র সবচে বড় গুণ হতে হবে- মানুষের সাথে নম্র ও কোমল আচরণ করা। 

মাওলানা ক্বারী তৈয়ব সাহেব রহ. একজন ‘দাঈ ইলাল্লাহ’র কিছু গুণ ও বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন- “একজন দাঈ, যে আল্লাহর পথে মানুষকে ডাকবে তার জন্য সবচে’ বড় গুণ হল- ‘ধৈর্য ও ছবর’। ধৈর্য ও ছবর ছাড়া দাওয়াতের কাজ করা সম্ভব নয়। কথায় কথায় চটে গেলে, সামান্যতেই গরম হয়ে গেলে, গালিগালাজ করলে মানুষকে দাওয়াত দেয়া সম্ভব নয়।” এজন্যই আল্লাহ তা’লা কুরআনে কারীমে এরশাদ করছেন- ‘হে রাসূল! আপনি ধৈর্য ধারণ করুন। আপনার ধৈর্য ধারণ একমাত্র আল্লাহ তা’লার জন্যই। এবং তাদের জন্য দুঃখবোধ করবেন না।’ (সূরা নাহল-১২৭)। 

মাওলানা ক্বারী তৈয়ব সাহেব রহ. একজন দাঈ’র দ্বিতীয় যে গুণটির কথা উল্লেখ করেছেন তা হল- “দাঈর সীরাত ও সূরাত, পোষাক ও বেশভূষা অবশ্যই রাসূল সা. এর মত হতে হবে। একজন দাঈকে দেখলেই যেন মনে হয় সে আল্লাহর রাসূলের প্রতিনিধিত্ব করছেন। রাসূলের পয়গাম মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন।” এ জন্যই আল্লামা ইবনে সিরীন রহ. বলেন- ‘তোমরা দ্বীন গ্রহণ করার আগে যাচাই-বাছাই করো, কার কাছ থেকে তোমরা দ্বীন গ্রহণ করছ?!” (সহীহ মুসলিম)।

দাঈ ইলাল্লাহ’র ভাষা ও বচন ভঙ্গি কেমন হবে এব্যপারে আল্লাহ তা’লা কুরআনে কারিমে এরশাদ করেন- ‘হে রাসূল! আপনি মানুষকে স্বীয় প্রভুর পথে আহ্বান করুন হিকমাত তথা প্রজ্ঞাপূর্ণ ভাষায় এবং উত্তম উপদেশের মাধ্যমে। আর লোকদের সাথে বিতর্ক করুন সর্বোত্তম পন্থায়।’ (সূরা নাহল- ১২৫)। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা শাব্বীর আহমাদ উসমানী রহ. বলেন- “এই আয়াতে আল্লাহ তা’লা মানুষকে দাওয়াত ও তাবলীগের তিনটি উপায় শিক্ষা দিয়েছেন- 
১. হিকমাত তথা মযবুত দলিল-প্রমাণের আলোকে, প্রজ্ঞাজনোচিত ভঙ্গিতে অত্যন্ত পরিপক্ক ও অকাট্য বিষয়বস্তু পেশ করা, যা শুনে বুদ্ধিমান ও প্রজ্ঞাবান লোকও আল্লাহর সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে দিতে বাধ্য হয়। 
২. মাওয়ায়েযে হাসানাহ অর্থাৎ মনোজ্ঞ ও হৃদয়গ্রাহী উপদেশ, যাতে আল্লাহ বিমুখ পাষাণ হৃদয়ও বিগলিত হয় এবং একটি হতাশ ও ক্ষয়ে যাওয়া জাতি গা ঝাড়া দিয়ে জেগে উঠে। 
৩. সর্বোত্তম পন্থায় তর্ক-বিতর্ক করা অর্থাৎ যারা হিকমাতপূর্ণ কথা গ্রহণ করে না এবং ওয়াজ-নসীহতেও কান দেয় না, বরং তর্কে লিপ্ত হতে চায় তাদের সাথে নিষ্ঠা এবং শিষ্টাচার বজায় রেখে উৎকৃষ্ট পন্থায় বিতর্ক করা। অহেতুক, বেদনাদায়ক ও শিষ্টাচার বর্জিত কথাবার্তা না বলা; যার দ্বারা সমস্যার কোন সুরাহা তো হয়ই না; বরং শুধুমাত্র আলোচনা প্রলম্বিত হয়। তাই একজন দাঈ’র তর্ক-বিতর্কের উদ্দেশ্য কখনোই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা নয়, বরং উত্তম পন্থায় প্রতিপক্ষকে উত্তর দেয়া এবং সত্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। (তাফসীরে উছমানী: ২/৬২৮-৬২৯)

আসন্ন ‘বিশ্ব ইজতিমা’ উপলক্ষ্যে মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি সদস্যের মাঝে রাসূলের সেই দাওয়াতি চেতনা জেগে উঠুক, ফিরে আসুক মুসলিম উম্মাহর সেই গর্বিত সমৃদ্ধ অতীত; এই দোয়া কামনায়। আল্লাহ সহায় হোন। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন